Uropaata Noboborsho Edition April 2022

উড়োপাতা একটু ছুটির সন্ধানে

April Edition 2022, Vol. 2

Poila Boisakh Edition

সূচীপত্র SUVO NOBOBORSHO 1429

01 সম্পাদকীয়

02 ফানুস 09 রহস্য রাণী AGATHA CHRISTIE

24

চঞ্চল পলাশ ও কবিতা

11

EXCLUSIVE!

AS WE GET READY TO GO BACK TO NORMAL

12

বিল্টুর পেন্সিল

15 ক্যাশ্মিয়ার

23

20

গৃহী মৈত্রী

ভালবাসা

uropaataonline@gmail.com

সম্পাদকীয় “মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। রসের আবেশরাশি শুস্ক করি দাও আসি, আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।।“ রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলি এবারের বৈশাখের জন্য ভীষণভাবে প্রযোজ্য। জরা, গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে অগ্নিস্নান করে শুদ্ধ হবার জন্য আমরাও উন্মুখ হয়ে বৈশাখের প্রতীক্ষা করছি। তাই এই নতুন বছরে আমরা আমাদের উড়োপাতাকে নতুন ভাবে সাজিয়ে তুলেছি। উড়োপাতার এই সংখ্যাটি নবারম্ভের প্রতীক। এই এডিশনে অনেকগুলি নতুন অংশ যোগ হয়েছে। আপনাদের সাহচর্য্যে এবং বিভিন্ন ধরনের মানুষের সম্মিলনেই এবারের উড়োপাতা অভিনব হয়ে উঠেছে। আপনাদের এই নতুন উড়োপাতা কেমন লাগল অবশ্যই জানাবেন। যে ঘটনাটির কথা এইবারের সম্পাদকীয়তে না বললেই নয় সেটি হল একটি বইপ্রেমী ভদ্রলোকের গল্প। তিনি আমার খুবই পরিচিত এবং অত্যন্ত ভালবাসার পাত্র। যাহোক এহেন ভদ্রলোকের জন্ম কলকাতায় হলেও বর্ত মানে কর্মসূত্রে তিনি পরিবারসহ সুদূর মুম্বাই নিবাসী। তাই কলকাতায় আসার জন্য মন যতই উতলা হোক না কেন হাজার কাজের ফাঁকে বছরে একবারের বেশি আসা হয় না। গতবছর (মানে ২০২১ সালের) ডিসেম্বর মাসের শেষে অনেকগুলি কাজ নিয়ে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন এবং ২ সপ্তাহ থেকেওছিলেন। এইসব নানান কাজের ফাঁকে তিনি জানতে পারেন কলকাতা বইমেলা গত দুবছর বন্ধ থাকার পর এবার আনুষ্ঠানিক ভাবে উদযাপিত হতে চলেছে। জানুয়ারির শুরুতে তিনি বোম্বে ফিরে যান। তবু মনের মধ্যে বইমেলায় যাওয়ার ইচ্ছেটা খালি ঘুরপাক খেতে থাকে। শেষে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই চুপিচুপি কলকাতার আরেকটি টিকিট কেটে ফেলেন তিনি ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের। কিন্তু এবারেও বিধি বাম। বইমেলা পিছিয়ে গিয়ে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হবে বলে জানা গেল। এদিকে বাড়ির লোক জানতে পেরে গেছে তিনি কলকাতায় আসছেন। তাই আরও কিছু কাজ দিয়ে তাঁকে পাঠানো হল। আমাদের বাড়িতে ধুমধাম করে সরস্বতী পূজা হয়। তিনি আসাতে মা ভীষণ খুশী। খুব করে ইলিশ মাছ, গল্প গাথা ইত্যাদিতে দারুণ একটা সন্ধ্যা কাটানো গেল। দুদিন থেকে তিনি ফিরে গেলেন। বইমেলার দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল তত ওই বইপাগল, ধীরস্থির মানুষটার জন্য আমার মন খারাপ হতে লাগল। একবার ভাবলাম একটা টিকিট কেটে ফেলি। আরেকবার না হয় মার্চে আসবে। (এইসব হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমি আমার পরিচিতদের মধ্যে খুবই বিখ্যাত বা কু খ্যাতও বলতে পারেন।) আবার পরক্ষোণেই ভাবি যে ওনার অফিসের কাজের ব্যাস্ততা সম্বন্ধে আমার কোন ধারণা নেই। দুম করে ওনাকে অপ্রস্তুত করাটা বোধহয় ঠিক হবে না। এইসব দোলাচলের মধ্যে আছি এমন সময় চিন্তামণি আমাকে সব চিন্তা থেকে মুক্ত করে দিলেন। এমন একটা ভীষণ জরুরী কাজ পরে গেল যে শুধু আমার পরিচিত সেই ব্যাক্তিই নয় আমার ভীষণ কাছের সহদরাও একসাথে কলকাতায় আগমন করলেন এক বৃহস্পতিবার রাত্রে। শুক্রবার সমস্ত কাজ সেরে শনিবারের ছু টিতে সবাই মিলে ঘুরে আসলাম বইমেলা। সেই ছোটবেলায় যখন বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে দুজনে মিলে যেতুম ময়দানের বইমেলায়, সেইসব দিনগুলোর কথা মনে পরে গেল। আমাদের সঙ্গে আরেকজন ভদ্রলোক গেছিলেন যাঁর বইয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। শুধুমাত্র আমার কাতর অনুরোধ আর বেনফিসের প্রলভন দেখিয়ে তাঁকে নিয়ে গেছি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনিও তিনখানি বই কিনে ফেললেন। পরে অবিশ্যি বলেছিলেন এবারের বইমেলা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এই বলে যে আমি এখান থেকে বই কিনেছি। আর সেই বইপ্রেমী ভদ্রলোক? তিনি এতগুলি বই কিনেছিলেন যে আমরা চারজন মিলেও সব টেনে আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। পরে আবার সেগুলি নিয়ে তিনি বোম্বে ফিরে যান। এই গল্পটি বলার উদ্দেশ্য একটাই। আমাদের জীবনে এখন সময় কাটাবার প্রচুর সরঞ্জাম আছে। মাঝে মাঝে এমনও হয় এই সমস্ত প্রলোভনের পাল্লায় পড়ে সময়কে খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু এর মধ্যেও যাঁরা নিজেদের বইয়ের প্রতি ভালবাসাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাঁদেরকে দেখে অনুপ্রেরণা পাই নতুন করে নিজের পুরনো অভ্যেসটাকে ঝালিয়ে নেওয়ার। George R R Martin এর বলা ওই কথাটি ধ্রুব সত্য; “A Reader lives a thousand lives before he dies.”

----------------প্রিয়দর্শিণী সেনগুপ্ত

ফানুস ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য সময় এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে মনের উৎফু ল্লতা মলিন হয়ে আসে অবনীর। উঁকি দেয় অনিশ্চয়তার মেঘ। আজ কি আর আসবে তু তু ? কে জানে। ভাবনায় অধীর হয় অবনী। বারান্দায় উঠে এসো এইবার, হিম পড়ছে। ঠাণ্ডা লাগবে। বলে সুধা। স্ত্রীর কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অবনী। ঠিকই বলেছে সুধা। হেমন্তের মাঝামাঝি। সন্ধ্যার হাত ধরে শিশির নামে এই সময়। তাছাড়া ঋতু পরিবর্ত নের দিনে ঠাণ্ডা কাবু করে সহজেই। বয়স তো থেমে নেই, এগিয়ে চলেছে সামনে। দিনে দিনে হাজার রোগ ব্যাধি হয়েছে সঙ্গী। তার উপর ঘাড়ের ব্যথাও বেগ দিচ্ছে খুব। সারা জীবন ছাত্র পড়ানোর হিসাব এইবার বুঝে নিতে চাইছে শরীর অবনীর কাছ থেকে। সেই বিকাল থেকে অবনী চেয়ে থেকেছে নাতি আসাবার পথ চেয়ে। তমাল আর বৌমাও আসবে। ওবেলায় ফোন করেছিল তমাল। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাবো বাবা, চিন্তা করো না। মনক্ষু ন্ন হয়েছিলো অবনী ছেলের কথা শুনে। গতকাল রাতেও বলেছিলো আজ সকালে আসবে। আর আজ বলে... সুধা বলেছিলো, কার্তি ক মাসের বেলা। বিকালের গায়ে গায়ে সন্ধ্যা উঁকি দেয়। এই তো কয়েক ঘন্টা, সবুর করো না বাপু। সে কথা ঠিকই, হেমন্তের অপরাহ্ন সংক্ষিপ্ত বড়ো। তবুও সুধা বললেই কি তর সয় অবনীর! দুপুর পার হতে না হতেই সদর দরজায় দাঁড়িয়ে, চেয়ে থেকেছে রাস্তার দিকে। তু তু আসবে। নাতির কথা ভেবে মনের অস্থিরতা সময়ের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে সারাদিন। আজ মাস ছয়েক পড় আসবে তু তু । ছয় মাস নয়তো, যেনো ছয় বছর! এতো দিন একমাত্র নাতিকে ছেড়ে থাকবার যন্ত্রণার উপসম পেতে অধীর হয়েছে মন। সেই কবে এসেছিলো তু তু এখানে। তাও মাত্র একদিনের জন্য। এবারে এসে নাকি থাকবে তিন চারটে দিন । এখন তো তু তু র নতু ন স্কু ল। শুরু থেকে পড়াশোনা না করলে গুছিয়ে নিতে পারবে না নিজেকে। পিছিয়ে পড়বে সবার চেয়ে। তাই সময় নষ্ট করলে চলবে না কেনো ভাবেই। গতবার এসে বলেছিলো অবনীর বৌমা। সত্যিই হয়তো তাই। ঠিকই বলছে বৌমা। ছোটদের পড়াশোনার চাপ তো এখন পাহাড় প্রমাণ। সুধা বলেছিলো রাখো তো ওই সব কথা। এখানে না আসবার অজুহাত। ছেলে যেনো আমরা মানুষ করিনি। এখানে বাচ্ছারা স্কু লে পড়ছে না! তমাল উচ্চ মাধ্যমিকে জেলায় সেকেন্ড হয়েছিলো এই ব্যান্ডেলের স্কু লে পড়েই। আর এতো বছর মাস্টারি করে তোমার বিচার বুদ্ধি কি লোপ পেয়েছে? যা বোঝাবে তাই বুঝতে হবে! কানে নিও না ওসব কথা। কারোর কথাই কানে নেয়নি অবনী। সবাই ঠিক বলে। সংসার বড়ো বিচিত্র জায়গা। এখানে কেউ নাকি ভু ল বলে না। আশ্চর্য্য! সবাই নির্ভু ল বলেই হয়তো এতো ভু লের মাসুল গুনতে হয় সকলকে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো, এখনো আসবার নাম নেই তমালদের। ফোনে খবরও দেয়নি কিছু। তাই চিন্তা নিয়ে বসে ছিলো বারান্দার সামনে। দু দুবার ফোন করেছে তমালের ফোনে। বৌমার ফোনেও চেষ্টা করেছে অবনী। সাড়া পায়নি ওপ্রান্ত থেকে। তাই মনের অস্থিরতা বেড়েছে আরো। ... অতো ব্যস্ত হচ্ছো কেনো? আসবে বলেছে যখন ঠিক আসবে। ওদেরও তো কাজ কর্ম থাকে। তাছাড়া সবে এই কয় মাস হলো ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। সেখানেও আজ পুজো। পাঁচ জনের কাজে পাশ কাটিয়ে চলে আসা যায় না মনে করলেই। সুযোগ সুবিধা করে আসবে ঠিকই। আর না এলে তু মি কি পারবে জোর করে আনতে? বাদ দাও। যার যা মন চাইবে

করুক। ভাবতে ভালো লাগে না আর। তু মি বারান্দায় এসে বসো। বলে সুধা। সে তো ঠিকই। না আসতে চাইলে জোর করে কি নিয়ে আসা যায় কাউকে। কতো দিন ধরেই তো অবনী বলছে তমালকে, তু তু কে নিয়ে আয় না একদিন। কই, আসেনি তো। কখনো আঁকা, কোনোদিন আবৃত্তি কোনোদিন বা ক্যারাটে ক্লাসের কথা শুনিয়েছে তমাল । অতো টুকু বাচ্ছা, অবসর কখন তাহলে! ভেবে শিউরে উঠেছে অবনী। বাচ্ছাদের পড়াশোনা আর সন্তানকে ঘিরে বাবা মায়ের স্বপ্ন এখন যেনো পাল্লা দিয়ে ছোটে! আট নয় মাস হলো হিন্দ মোটরে ফ্ল্যাট কিনেছে তমাল। রোজ রোজ অফিস যাতায়াতের ধকল আর নিতে পারছে না শরীর। অসুবিধা হচ্ছিলো তমালের স্ত্রীরও। সেই ছুটতে ছুটতে গিয়ে ট্রেন ধরা। সকাল থেকেই তাড়াহুড়ো। বাচ্ছার দিকে নজর দেবার সময় নেই। তাছাড়া কলকাতার দিকে পড়াশোনার সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি। এদিকে তেমন স্কু ল আর কোথায়! এইসব ভেবেই নাকি তমালের হিন্দ মোটরে থাকা। সুধা বলে অন্য কথা। তাই যদি হতো এতো দিন পরে বুঝলো সে কথা! চাকরি কি আগে করেনি ওরা এখানে থেকে। এই আট বছরে ব্যান্ডেল থেকে কি হিন্দ মোটরের দূরত্ব বেড়ে গেছে? তা তো নয়। অসুবিধা ঠিক এখনই শুরু হলো! আর বাচ্ছা কি অপরিচিত কারোর কাছে ছিলো সারাদিন! আসলে... আসলে যে কি সে হিসাব মেলাতে পারেনি অবনী। সংসারে সবার হিসাবের নিক্তি এক তো নয়। সবার তৌল এক নিয়মে চলে না। বৌমার হিসাবের কৌশল সুধার চেয়ে পৃথক। সুধার যোগ বিয়োগের নিয়ম অন্য রকম। তমালের হিসাব কি সহজ বোধ্য? কে জানে, কোন সূত্র মেনে হিসাব করে তমাল। হয়তো তমালও ঠিক ওর নিজের বিচারে। শুধু এইটুকু বুঝেছে অবনী সবাই সবার অঙ্কে ঠিক। আর সবার সঠিক ভাবনা তার সুখের পৃথিবীটাকে দিয়েছে দু টুকরো করে। মাঝে মাঝে মনে হয় অবনীর, জগতের সমুদয় আনন্দ নিয়ে গেছে কেউ ছিনিয়ে। চেনা মানুষ গুলো মধ্যে মধ্যে হয়েছে অচেনা। পৃথিবী বুঝি ঊষর মরুময়। এই আট নয় মাসে মনের শান্তি তলানি ছুঁ য়েছে। এক পৃথিবীতে বসে অন্য পৃথিবীর চিন্তায় বুঁদ হয়ে থেকেছে অবনী। কতদিন রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেছে। না ঘুমানো রাত হয়েছে ভোর। কোথা থেকে কি হলো বুঝতে পারে না। শেষে হাল ছেড়েছে। সত্তর বছর বয়সে এসে নতু ন করে আর সংসারের হিসাব শিখতে সায় দেয় না মন। তবে এইটুকু বোঝে সহজেই, তু তু কে আর কাছে পাবে না কোনো দিন। এরপর কখনো কখনো হয়তো তু তু আসবে এখানে। দেখে যাবে অবনীকে। দিনে দিনে ভাটা পড়বে সে আসা যাওয়ায়। তারপর তারপর অবনীও অভ্যস্ত হয়ে উঠবে তার নিজের পৃথিবীতে। নাতির জন্য মনের মধ্যে তোলপাড় করা ব্যাকু লতা স্তিমিত হবে একদিন। সুধারও সমস্ত অভিমান যাবে থিতিয়ে। জীবনে চাওয়া পাওয়ার হিসাব নিতে চাইবে না মন। বারান্দায় উঠে এসে বসে অবনী। গলা থেকে কলারটা খোলে। ধীরে ধীরে শরীরটা এলিয়ে দেয় সোফায়। ক্ষণিক আরাম আচ্ছন্ন করে রাখে। বুজে আসে দু চোখের পাতা। অন্য দিন দুপুরে বিশ্রাম নেয় কিছুক্ষণ। আজ আর ইচ্ছে হয়নি। নাতি আসবে। আনন্দে শরীর যেনো নিজের থেকেই বিশ্রামে অনিচ্ছার কথা শুনিয়ে ছিলো। সময়ের সঙ্গে এখন সে আনন্দে ঘাটতি এসেছে বুঝি, তাই এই অসময়ে... কি হোলো? এখন হঠাৎ কলার খুললে কেনো? শরীর খারাপ লাগছে? জিজ্ঞাসা করে সুধা। না এমনিই, বলে অবনী। গলায় কলার অবনীর চব্বিশ ঘণ্টার সঙ্গী।শোয়া আর স্নান ছাড়া সব সময় গলায় কলার পড়ে থাকতে হয়। ডাক্তার বাবুর নির্দে শ তেমনই। নিয়মের নড়চড় হতে দেয় না সুধা। স্বাভাবিক। অবনীর কিছু হলে সুধাকেই সামলাতে হয় সমস্ত ঝক্কি। এইতো মাস দুয়েক আগের কথা। পোস্ট অফিস যেতে গিয়ে পথেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো অবনী। দুশ্চিন্তায় স্নান খাওয়া ভু লে ছিলো সুধা। না জানি কোন বিপদ এলো। পরে সুধাকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে, স্পণ্ডালাইটিস। তারপর থেকেই অবনীর টিউশন পড়ানোর পাঠ তু লে দিয়েছে সুধা। আর এতে যেনো সময় থমকে দাঁড়িয়েছে অবনীর। তবু সকাল বিকেল কয়েক ঘন্টা সময় কাটতো ইংরেজি গ্রামার, সিন আনসিন প্যাসেজ পড়িয়ে। কিছুটা সময় তু তু র ছায়া ঝাপসা হতো মনে। এখন সকাল, দুপুর, বিকাল অবনীর কর্মহীন মন নাতির জন্যই ব্যাকু ল হয়ে থাকে। জীবন বুঝি নিস্তরঙ্গ জলাশয়। সহস্র শৈবাল বুকে নিয়ে চেয়ে থাকে আকাশের পানে। গুমরে মরে মনে মনে। অস্বাভাবিক তো নয়, বার্ধ্যকে মন নাতি নাতনিদের সঙ্গে থেকেই তৃ প্তি খুঁজে পায়। মনের স্থানু দুর্ভাবনা গুলি হালকা হয়ে আসে শিশু মনের পরশে। আসলে বার্ধক্যে শৈশব আবার হাজির হয় মনে। সেই পরিণত শৈশব শিশুর খেয়ালী শৈশবের সঙ্গে হাঁটতে চায় টলমল পায়ে। সে প্রাপ্তির সুখ অনাবিল। ভারী হয় অবনীর বুক হারিয়ে যাওয়া সুখের কথা ভেবে।

এই নাও, তোমার চা। কলারটা পড়ে নিও আবার। আমি একবার ওই দিকে দেখে আসি। অবনীকে চা বিস্কু ট দিয়ে সুধা যায় বোস বাড়ি। আজ কালী পুজো। বছরের এই দিনটায় নির্জলা উপবাসী থাকে সুধা। মা কালীর চরণে অঞ্জলী দিয়ে ভঙ্গ করে তার উপবাস। পরিবারের মঙ্গল কামনায় তার এই ব্রতে ছেদ পড়েনি কোনোদিন। তমালের জন্মের পড় থেকে এই কাজে একনিষ্ঠ সুধা। ভেবে অবাক হয় অবনী। তমালকে নিয়ে বৌমাকে নিয়ে সুধার অভিযোগ কম নয় কিছু । কথায় কথায় ঠিকরে বাইরে আসে মনের ক্ষোভ। তবুও তাদের মঙ্গল কামনায় উপবাসী থাকে সুধা নানান পুজোয়, বার ব্রতেও। সত্যি, সংসার বিচিত্র বড়ো। জটিল, ভীষণ জটিল হিসাবের নিয়ম। ভালো লাগা, মন্দ লাগার প্রকাশও সরল নয় মোটেই। সুধা চলে যায়। কিছুটা আনমনা হয়েই চায়ে চুমুক দেয় অবনী। অন্য দিন সন্ধ্যার এই চা পর্ব দুজনের নানা কথায় এগিয়ে চলে বেশ কিছুটা সময়। অবশ্যই তু তু র কথা আসে। রোজই এই সময় নাতিকে একবার ফোন করে অবনী। তমালের অফিস থেকে ফিরতে বেশ দেরী হয়। অবশ্য বৌমা ফিরে যায় স্কু ল থেকে। তাই বৌমার ফোনেই ফোন করে অবনী। কথা বলে নাতির সঙ্গে। পাঁচ মিনিটের কথা শেষে পঁচিশ মিনিট ধরে সে কথা গুলি চর্বণ করে সুধা আর অবনী। গতকালও এই সময়েই ফোন করেছিলো। নয়তো খানিক পরেই তু তু র টিচার আসে বাড়িতে। তখন আবার ফোনে করলে পড়ার ক্ষতি হয়। বাচ্ছা ছেলে। মন চলে যায় অন্য দিকে। সে কথা ভেবেই সন্ধ্যার আগে আগেই ফোন করে অবনী, রোজ। গতকাল তু তু বলেছিলো দাদু ফানুস কিনে রাখবে। পাঁচটা। হেসে বাঁচেনা অবনী! বলে কিনা পাঁচটা ফানুস লাগবে। তারপর বলে, সুধাকে বলবে যেনো রোদে রেখে দেয় ফানুস। নয়তো উড়বে না। আমি সকাল সকাল পৌঁছে যাবো। বাব্বা! বাচ্ছা ছেলের কথা একেবারে গোছানো। ঠিক জানে কাকে কোন কাজটার কথা বলতে হয়। সেই নিয়েই হাসাহাসি চলে কিছুক্ষন। রোজই তু তু র কোনো না কোনো কথা নিয়ে অবনী আর সুধার আনন্দ বাঁধ ভাঙ্গা হয়। বেশ কিছুক্ষণ চলে সেই আনন্দ ধারা। তারপর কথায় কথায় কখন যে সিঁদ কাটে অন্য প্রসঙ্গ, বুঝে পায় না অবনী। সুধাও। উচ্ছ্বল মুহূর্ত গুলি অজানা কার নির্দে শে হয়ে ওঠে নিশ্চুপ। ধীরে ধীরে ফু রিয়ে আসে অবনী আর সুধার কথা। বিবর্ণ হয়ে আসে মনের মুহূর্ত সুখ। সময়ের পল অনুপল এগিয়ে যায় বাকহীন হয়ে। দুজনের মনের মধ্যে বলতে না চাওয়া কথা গুলি ঠেলাঠেলি করে একে অপরকে। এক বোধ্য আড়ষ্টতা সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মনের চৌকাঠে। টের পায় দুজনেই । ভারী হয়ে ওঠে ঘরের বাতাস। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে যায় সুধা। রান্না ঘরে কাজের অছিলায় আড়ালে চোখের জল ফেলে। আর অবশ মনে বসে থাকে অবনী। একলা। এক খন্ড মুহূর্ত ঘুর ঘুর করে অবনীর চারপাশে। মনে করিয়ে দিয়ে যায় আলো ঝলমলে সে রাতের এক ছোট দৃশ্য। কাঁদছে তু তু । ফানুস লাগবে তার। ছোটো ছেলের বায়না। সুধা ব্যস্ত নাতিকে ভোলাতে। ওদিকে তমাল আর বৌমা... হাজার বাতির আলো মুছে আঁধার ঘনিয়ে এসেছিলো বাড়িতে সেই রাতে। তারপর কতো কথা। কতো কথা। তমাল, সুধা, বৌমা। ক্ষোভ, বিক্ষোভ, রাগ, অভিযোগ, অভিমান সহস্র শব্দে আছড়ে পড়ে বারান্দায়। একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো অবনী। অপ্রত্যাশিত বিহ্বলতা জাপটে ধরে ছিলো। ওদের কথার তোড়ে ভেসে গিয়েছিল তু তু র কান্না। হতচকিত সে। এমন দৃশ্য অপরিচিত তার কাছে। শেষে চিৎকার করে কেঁ দে ওঠে আবার। তু তু কে কোলে নিতে যায় সুধা। ছিনিয়ে নেয় বৌমা। শুরু হয় আর একপ্রস্থ কথা চালাচালি। অবনীর বুক শীতল হয়ে এসেছিলো সে রাতে। তার পর পরই তো বদলে যেতে লাগলো পৃথিবী। সবুজের সতেজ প্রলেপ ফিকে হতে হতে আজ ধূসর, রুক্ষ সবই। তারপর... এক বছর আগের কথা। তারপর থেকে এ বাড়ির সবার পা ফেলা হিসাব করে। সুধা, বৌমা, তমাল সবাই সাবধানী হয় পা ফেলেছে। অবনীও। রোজ, রোজ সে রাতের কথা ভাবে অবনী। সত্যি, সংসার বড়ো বিচিত্র। দূর্বোধ্য তার ভাব গতিক। কোন ছোট্ট মুহূর্ত কখন কিভাবে এসে স্থায়ী দাগ রেখে যায় কে বলতে পারে! একটা শ্বাস দীর্ঘ হয়ে বাইরে আসে অবনীর। মনের অতলে জ্বলতে থাকা যন্ত্রণার আগুনে বাতাস বুঝি। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে টি টেবিলে কাপ নামিয়ে রাখে অবনী। চোখ যায় দেওয়াল ঘড়ির দিকে। ছয়টা দশ বাজে। তমালরা পথে আছে হয়তো। মনে মনে একটা রাগ ঘনিয়ে আসে। ফোনও তো করতে পারে তমাল। কতো দূরে আছে বললেই মিটে যায়। এতক্ষনে একবারও কি মনে পড়েনি যে চিন্তা করবে অবনী। মনের অধীরতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝিমিয়ে আসে কিছুটা। বিষণ্ণতা ছায়া ফেলে মনে। দানা বাঁধে সংশয়, হয়তো নাও আসতে পারে ওরা। কাল বাড়ি যাবো দাদু, বলেছিলো তু তু । তারপর থেকেই অবনীর মন তু তু র আসবার মুহূর্ত টাকেই মনে করে সুখে থেকেছে। এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূ তির মৌতাতে আচ্ছন্ন ছিলো সারা দিন। বুঝিয়েছে নিজেকে আর তো কয়েকটা ঘণ্টা। এ ভাবেই কাল সন্ধ্যা থেকে হিসাব রেখে পার করেছে রাত্রি, সকাল, দুপুর।

এই সময় রোজ একটা ওষুধ থাকে অবনীর । ঘড়ি দেখে।সাড়ে ছয়টা বাজে। বয়স এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে ওষুধই মনে করিয়ে দেয় সময়ের হিসাব। বার্ধক্যের এ আর এক যন্ত্রণা। সুধা আসবে নিশ্চয়ই। নয়তো মনে করিয়ে দিয়ে যেতো অবনীর ওষুধের কথা। ফ্রিজের পাশের টেবিলে রাখা রয়েছে ফানুসের প্যাকেট। চেয়ে থাকে অবনী। লাল, নীল, হলুদ নানা রং মিলিয়ে পাঁচটা ফানুস আজ সকালে কিনে এনেছে অবনী। সারা দুপুর সে গুলিকে রোদে রেখেছিলো সুধা। গতকাল বৃষ্টি হয়ে গেছে। রোদে না দিলে নেতিয়ে থাকবে ফানুস। আজ সারাদিন মাঝে মধ্যেই ফানুস গুলোর দিকে চেয়ে থেকেছে অবনী। কল্পনায় উড়তে দেখেছে আঁধার আকাশে। মনের খুশি অধীর হয়ে পাক খেয়েছে ফানুসের চার পাশে, রঙিন প্রজাপতি যেনো। বিকেল বেলায় ফানুসে হাত দিয়ে দেখেছে নিজে ভেজা ভাব আছে কিনা তাতে। সুধা বলে অতক্ষণ রোদে রাখার পর ভেজা ভাব থাকে কি করে! তু মি বাপু আচ্ছা মানুষ। সুধা যতই বলুক, নিজে হাত দিয়ে দেখে তবেই নিশ্চিন্ত হয়েছিলো অবনী, না ভিজে ভাব নেই ফানুস গুলোয়। গত বছর কালী পুজোর আগের দিন বৃষ্টি হয়ে ছিলো বেশ কয়েক পশলা। স্যাঁত স্যাঁতে বাতাসে নেতিয়ে ছিলো ফানুস। কিছুতেই জ্বলে না। শেষে ছিঁড়েই গেলো। আর তু তু র সে কি কান্না। আবার ফানুস আনতে হবে। অবনী, সুধা দুজনেই ব্যস্ত নাতিকে বোঝাতে। কাল আবার তোমার জন্য ফানুস কিনে নিয়ে আসবে দাদু, বলে সুধা। তু তু মানবে না কিছুতেই। শেষে বাধ্য হয়ে সুধা বলে তমালকে। যা না একবার বাজারে। নিয়ে আয় ফানুস। তোরা বাচ্ছা ছেলের কান্না দেখতেও পারিস। সে কথা শুনে ফুঁ সে ওঠে তমালের স্ত্রী। হয়তো সবার অলক্ষ্যে মনের মধ্যে তু ষের আগুন জ্বলেই ছিলো অনেক দিন ধরে। সুধার কথায় বাতাস পেয়ে বাইরে আসে বৌমার মনের আগুন। মুহূর্তে বদলে যায় পরিস্থিতি। সেই ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যেই ওরা চলে গেলো হিন্দ মোটর, ফ্ল্যাটে। তারপর থেকে একবারই এসেছে সবাই মিলে এখানে। ভাবনায় ছেদ পড়ে অবনীর। সুধা আসে। একটু পরেই পুজো শুরু হবে বোসেদের বাড়ি। অবনীর ওষুধের কথা মনে করেই এখন বাড়ি এসেছে সুধা। তু মি ওষুধ খেয়ে ঘরে গিয়ে বসো। তেমন তেমন বুঝলে বারান্দার গেটে চাবি দিয়ে দাও। ওরা মনে হয় আর আসবে না, এলে চলে আসতো এতক্ষনে। বলে সুধা। অবনী বোঝে সুধার শেষের কথা গুলো মনের তীব্র অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। চলে যায় সুধা। একলা বারান্দায় বসে থাকে অবনী। বোসদের বাড়িতে ঢাকের শব্দ লম্বা হয়ে বেজে ওঠে। বাড়ি থেকে শুনতে পায় অবনী। পুজো শুরু হলো এইবার। অঞ্জলী দিয়ে বাড়ি আসতে প্রায় দশটা বাজবে সুধার। বারান্দার সামনে আলো আঁধার। গ্রীলের নক্সা পার করে অবনীর দৃষ্টি হেঁ টে চলে উঠানে। পথ হারায় উঠানের আলো ছায়ায়। বহু বছর পর আজ কালী পুজোর রাতে গোটা বাড়িটাকে গ্রাস করেছে আঁধার। তমাল থাকলে ঠিক জ্বেলে দিতো আলোর ঝাড়। গেলো বারও দোতলা থেকে নানা রঙের আলোর মালা ঝু লিয়ে সাজিয়ে ছিলো গোটা বাড়ি। পুজোর খুশি উপচে পড়ে ছিলো। তাই দেখে তু তু বলেছিলো বাবার সঙ্গে গিয়ে সেই নাকি কিনে এনেছে সমস্ত আলো। পাকা বুড়ো। হঠাৎ করেই বুকটা কেমন ডু করে ওঠে অবনীর। সদ্যজাত কান্নার বুদবুদ হয়তো। কতদিন আসেনি তু তু । তমাল সময় করে এসেছে মাঝে মাঝে। খবর নিয়েছে বাবা মায়ের। সুধা একদিন বলেছিলো তমালকে, ছেলেটাকে আর বৌমাকে তো আনতে পারিস একবার। তোমার বৌমা কি ছেলে মানুষ? নাকি আমি এখানে আসতে বারণ করি? তমালের কথা শুনে যা বোঝার সবই বুঝেছিল সুধা। অবনীও ছিলো পাশে। আর তু তু র নাকি রবিবারই আঁকা, আবৃত্তি আর ক্যারাটে ক্লাস থাকে। তোমরাও তো যেতে পারো। আমাদেরও ভালো লাগে তাহলে। যাবো, বলেছিলো অবনী। সুধার সময় হয়নি তারপর থেকে। কোনো না কোনো অজুহাতে পাশ কাটিয়ে গেছে ঠিক। শেষে একদিন বলে কই বৌমাতো বলেনা কোনো দিন। ফোন করে বলেছে কখনো নতু ন ফ্ল্যাটে আসতে ? সেটা অবশ্য অবনী খেয়াল করেছে। বৌমা সুধার সঙ্গে কথা বলেনা। ব্যাপারটা তু মিই তো মিটিয়ে নিতে পারো। অবনীর কথা শুনে সুধা বলেছিলো বৌমাও তো পারে একবার আসতে। দরজা কি বন্ধ থাকে? নাকি আমি... গলা ধরে এসেছিলো সুধার। কে পারে, কে পারে না এই প্রশ্নের মীমাংসা আজও অধরা অবনীর। হঠাৎ করেই সদর দরজা খোলার শব্দ কানে আসে। চকিতে সেই দিকে চোখ ফেরায় অবনী। আকাশের বিদ্যুৎ বিকাশের মতো আশার ঝিলিক মন ধাঁধিয়ে দিয়ে যায়। তু তু এলো হয়তো। অশেষ আশায় স্নাত দৃষ্টি দৌড়ে যেতে চায় সদর দরজার দিকে। বারান্দার পিলারে বাধা পায় অবনীর তৃ ষিত দৃষ্টি। সোফা থেকে উঠে আসে দু পা। চেয়ে থাকে সদর দরজার দিকে। আশাহত হয় অবনীর অধীর মন। না, তমালরা আসেনি। সুধা এসেছে আবার। মনের আশার সুর সঙ্গতহীন হয়ে বেসুরে বাজে বেসুরে। সোফায় এসে বসে আবার। বুজে আসে দু চোখ। অবসন্ন মন। উঠান পেরিয়ে বারান্দায় পা রাখে সুধা। বলছি, আমি সদরে চাবি দিয়ে যাচ্ছি। তু মি এবার ঘরে গিয়ে বসো। সুধা চলে যায়। ফোন হাতে নেয় অবনী। তমালকে ফোন করে। একটানা রিং হয়ে চলে। ওহ! বিরক্ত হয়ে ঘরে আসে অবনী। এবার বেজে ওঠে অবনীর হাতের ফোন। তমাল ফোন করেছে। কথা বলে অবনী। নিঃশেষ হয়েছে আশা। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসে বিছানার উপর। বিধ্বস্ত অবনীর মন। তু তু আসবেনা। সারা দিন উপবাসী থেকে পুজোর জন্য ভোগ রান্না করেছে তমালের স্ত্রী। মাইগ্রেনের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে ভীষণ।

কষ্ট তো অবনীও পাচ্ছে। সে কথা বলবে কাকে। গতকাল থেকে নাতিকে কাছে পাবার আশায় এক অন্য জগতে বাস করেছে অবনী। তমালের কথা শুনে শেষ হয়েছে মনের সমস্ত আশা। বিছানা থেকে চেয়ে থাকে ফানুস গুলোর দিকে। নানা রঙের পাঁচটা ফানুস। এক ভাবনাহীন চাউনি আঁকড়ে ধরে ফানুসের প্যাকেটটাকে। সারাদিন উড়তে থাকা রঙিন প্রজাপতি গুলো আর নেই এখন। সময় এগিয়ে যায় নিঃশব্দে। চুপটি করে বসে থাকে অবনী। ফোন বেজে ওঠে আবার। ওপ্রান্তে তু তু । হ্যালো দাদু বুকের মধ্যে ছুটে চলা উদভ্রান্ত কান্না গুলি ভিড় করে অবনীর গলায়। বিদ্রোহী তারা, বাইরে আসবে এখনি। বহু কষ্টে শব্দ আসে অবনীর মুখে। বলে, বলো দাদুভাই মায়ের শরীর ভালো নেই, তাই... অবনী বধির যেনো। তু তু র কোনো কথা কানে আসছে না। এক অবশ ভাবনা ছেয়ে আসে মনে। হ্যালো, তু মি লাইনে আছো দাদু? জিজ্ঞাসা করে তু তু । হ্যাঁ, শুনছি তো... শেষ করতে পারে না অবনী তার বলতে চাওয়া কথা। মিলিয়ে যায় বাতাসে। হ্যালো দাদু, জানো ফ্ল্যাটের ছাদে এসে আমরা সবাই ফানুস... ফানুস জ্বেলে আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে তু তু । ভীষণ আনন্দ তার মনে। জিজ্ঞাসা করে অবনীকে, তু মি দেখতে পাচ্ছো দাদু আমার ফানুসটা? ভালো করে দেখো উড়ে যাচ্ছে, ওই যে লাল রঙের ফানুস। ফ্রিজের পাশের টেবিলে রাখা ফানুস গুলোর দিয়ে চেয়ে থাকে অবনী। বলে, একটা তো নয় দাদুভাই। পাঁচটা ফানুস... ধ্যাত, কোথায় পাঁচটা! ভালো করে দেখো ওই দূরে চলে যাচ্ছে লাল রঙের... কথা নেই অবনীর মুখে। বিদ্রোহী কান্না গুলি বাইরে আসে একযোগে। ফোনটা ধরে থাকে কানের পাশে। ও প্রান্তে তু তু বলে চলে কিভাবে তরতর করে আকাশে উড়েছে তার ফানুস। ভীষণ খুশি তু তু আজ। ফানুস উড়েছে আকাশে। টেবিলের ফানুস গুলোর দিকে চেয়ে থাকে অবনী। নিথর হয়েছে দৃষ্টি। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে চশমার কাঁচ। অবনীর পৃথিবীতে চলে নিরবে ধারাপাত। ওই পৃথিবীতে আকাশে পাড়ি দিয়েছে তু তু র ফানুস। উড়ে চলে দূরে, আরো আরো দূরে।

।।সমাপ্ত।।

রহস্য রাণী Agatha Christie আনন্দিতা সরকার দেশে, বিদেশে যুগে যুগে গোয়েন্দা গল্পের লেখক হিসাবে আমরা পুরুষকেই দেখে এসেছি। কিন্তু তাদের মাঝখানে বসে আগাথা ক্রিস্টি নিজের লেখনীর দ্বারা নিজেকে গোয়েন্দা গল্পের সম্রাজ্ঞী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ওনার গল্প গুলো শুধু রহস্য রোমাঞ্চেই ভরা নয়, খুবই নাটকীয়ও। তার অন্যতম কারণ হল আগাথা ক্রিস্টি ছিলেন ভয়ংকর ভাবে নাটক প্রেমী। ওনার আত্মজীবনীতে উনি লিখেছেন : “One of the great joys in life was the local theatre. We were all lovers of the theatre in our family.” অর্থাৎ নাটক ওনার রক্তে ছিল। ছোটবেলায় উনি ওনার ভাই Monty আর বোন Madge র সঙ্গে প্রত্যক সপ্তাহে নাটক দেখতে যেতেন। শুধু নাটক দেখতে যাওয়া নয়, উনি নাটকে অভিনয়ও করেছেন – “The Mallocks at Cockinton Court” নামক নাটকটিতে। শুধু তাই নয় ওনার প্রথম উপন্যাস “The Mystery Affairs at Styles” লেখার আট বছর আগে উনি ওনার প্রথম নাটক লেখেন। কু রিটির উপর নাটক ওনার মঞ্চে প্রদর্শিত হয়েছে যার মধ্যে প্রথম এবং অন্যতম নাটকটি হল “Black Coffee” যেটি উনি ১৯৩০ সালে লেখেন। আগাথা ক্রিস্টি দুটি বিশ্ব রেকর্ড ও স্থাপন করেছেন: 1. প্রথমটি ওনার লেখা নাটক “Mouse Trap” দীর্ঘতম দিন ধরে মঞ্চে প্রদর্শিত হচ্ছে (১৯৫২ থেকে আজ অবধি) 2. দ্বিতীয় উনি প্রথম মহিলা নাট্যকার যার লেখা তিনটি নাটক এক সঙ্গে London West End মঞ্চে প্রদর্শিত হয়েছে - Mouse Trap - Witness for the Prosecution - Spider’s Web আগাথা ক্রিস্টির লেখা মোট ৬৬ টি উপন্যাস আর ১৪ টি ছোট গল্প সংগ্রহ ছাপা হয়েছে। ওনার লেখা সর্বাধিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে (১০০ টি ভাষায়)। ওনার লেখা “And Then There Was None” গল্পটির ১০০ মিলিয়ন কপি ছাপা হয়েছে। Hercule Poirot ওনার লেখা সবচেয়ে অন্যতম আর জনপ্রিয় চরিত্র। আগাথা ক্রিস্টি তার ৩৩ টি উপন্যাস, ২ টো নাটক (“Black Coffee” আর “Alibi”) আর মোট ৫০ টি ছোট গল্পে Hercule Poirot কে তু লে ধরেছেন। যদিও তিনি নিজে British মহিলা, Hercule Poirot কিন্তু ছিলেন Belgian। Hercule Poirot ছিলেন ভীষণ খুঁতখুঁতে, ছোটখাটো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মানুষ যার “little grey cells” সব জটিল সমস্যা এক নিমেষে সমাধান করে দিত। আগাথা ক্রিস্টি এক জায়গায় Hercule Poirot কে বর্ণনা করেছেন “having an egg shaped head, often tilted to one side and eyes that shine green when he’s exited”। আরেক জায়গায় উনি বর্ণনা করেছেন “Short, somewhat vain, with brilliantined hair and a waxed moustache, the aging bachelor Poirot enjoys his creature comforts”।

আগাথা ক্রিস্টি আরও অনেক চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যাদের প্রত্যেকের অনুসন্ধান করার পদ্ধতি আলাদা এবং অনবদ্য। Hercule Poirot র পরে তার সৃষ্টি অন্যতম চরিত্র হল মিস মারপেল – এক বৃদ্ধা অবিবাহিত মহিলা যার পর্যবেক্ষণ শক্তি খুব তু খড়। উনি একটা ছোট্ট গ্রামে থাকতেন। ওনার রহস্য সমাধান করার পদ্ধতি টাও খুব অসাধারণ ছিল, উনি মানুষের সঙ্গে একদম মিলে মিশে যেতেন, পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে পরনিন্দা পরচর্চা করতেন আর উল বুনতে বুনতে সব দিকে নজর রাখতেন, সব কথা শুনতেন। এইরকম ভাবে উনি সব জরুরি তথ্য যোগার করে ফেলতেন আর রহস্য সমাধান করে ফেলতেন। আগাথা ক্রিস্টি বলেছেন যে মিস মারপেলের চরিত্র উনি ওনার ঠাকু মার সাদৃশ্যে তৈরি করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে উনি ওনার ঠাকু মাকে মিস মারপেলের সঙ্গে তু লনা করে বলেছেন “Miss Marple was far more fussy and spinsterish than my grandmother ever was. But one thing she did have in common with her – though a cheerful person, she always expected worst of everything, and was, with almost frightening accuracy usually proved right.” মিস মারপেলকে কেন্দ্র করে আগাথা ক্রিস্টি বারোটি উপন্যাস আর কু ড়িটি ছোট গল্প লিখেছেন। Hercule Poirot আর মিস মারপেল ছাড়াও আগাথা ক্রিস্টির তৈরি উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হোল Tommy and Tuppence, Harley Quin আর Parker Pyne। রহস্য গল্প ছাড়াও উনি কিছু প্রকৃ ত তথ্য ভিত্তিক সাহিত্য লিখেছেন যেমন : “Come tell me how you live” – Mallowan এর সঙ্গে উনি যে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করেছেন তার উপর, “The Grand Tour: Around the World with the Queen of Mystery” – ১৯২২ এ ওনার সাউথ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিলান্দ আর কানাডা সফর সম্বন্ধে লেখা, “Agatha Cristie : An Autobiography” – ওনার আত্মজীবনী যার জন্য উনি মরণোত্তর ১৯৭৮ সালে Best Critical/Biographical Work Edgar Awards পেয়েছেন। উনি Marry Westmacott ছদ্মনামে ৬ টি উপন্যাস ও লিখেছেন। ওনার লেখা অবলম্বনে দেশে বিদেশে প্রচুর ধারাবাহিক আর চলচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। ভারতীও পরিচালকরা ওনার দ্বারা প্রচুর অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কিছু কালজয়ী বাংলা ও হিন্দি ছবি যেগুলো ওনার লেখা অবলম্বনে বানানো হয়েছে সেগুলো হোল: 1. প্রেমেন্দ্র মিত্র দ্বারা পরিচালিত “চুপি চুপি আসে” যেটি ১৯৬০ এ মুক্তি পেয়েছে – এই ছবিটি আগাথা ক্রিস্টির “Mouse Trap” গল্পটি থেকে অনুপ্রাণিত। 2. রাজা নাওাথে দ্বারা পরিচালিত ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া বিখ্যাত ছবি “Gumnam”। এই ছবিটি বিশ্ব বিখ্যাত “And then there was none” উপন্যাসটির ছায়ায় বানানো হয়েছিল। 3. ১৯৭৩ এ মুক্তি পেয়েছিল B R Chopra নির্দে শিত “Dhund” ছবিটি যেটা আগাথা ক্রিস্টির “The Unexpected Guest” গল্পটি অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল। 4. ঋতু পর্ণ ঘোষ ২০০৩ সালে একটি ছবি “শুভ মহরথ” নামে পরিচালনা করেন যেখানে রাখি গুলজার কে মিস মারপেলের ভূ মিকায় দেখা যায়। এই ছবিটি “The Mirror Crack'd from Side to Side” কাহিনীটির অবলম্বনে তৈরি করা হয়। 5. ২০১২ সালে একটি মালায়ালি ছবি “Grand Master” নামে মুক্তি পায় যেইটা আগাথা ক্রিস্টির “The ABC Murder” উপন্যাসটির ছায়ায় বানানো হয়েছে। আমি ছোটবেলা থেকেই খুব রহস্য প্রেমী, দেশে বিদেশের প্রচুর গোয়েন্দা গল্প আমি পরেছি। কিন্তু আমি একবাক্যে বলতে পারি যে আগাথা ক্রিস্টির মতো এতো বৈচিত্র্যময় গোয়েন্দা গল্পের লেখিকা আমি দেখিনি। Arthur Conan Doyle র Sherlock Homes বলুন, শরদিন্দুর ব্যোমকেশ বক্সী বলুন কি সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা বলুন সব লেখকই একটা গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেছেন কিন্তু আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা চরিত্রের সংখ্যা অপরিসীম। তার সৃষ্টি কোন গোয়েন্দা ডাঁটিয়াল বৃদ্ধ, কোন গোয়েন্দা একাকিনী বৃদ্ধা যিনি সারাদিন উল বোনেন, কোন গোয়েন্দা দম্পতি , আবার কোন গোয়েন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। তার এই বহুমুখিতা আমাকে বারেবারে মুগ্ধ করেছে। তাই বলা যেতে পারে উনি শুধু গোয়েন্দা গল্পের সম্রাজ্ঞী নন - উনি গোয়েন্দা গল্পের ভগবান।

।।সমাপ্ত।।

As we get ready to go back to "Normal" …

Sreemoyee Dutta

I have been experiencing mixed emotions. Do I want to go back to office? Do I want to travel for 2 hours on an average every day? Do I want to dress up prim and proper every day?

Those are things that I will tackle as each day comes. I am aware many of our friends had to go to office even when there was complete lock-down. Specially the bankers.

There were many who enjoyed getting to know their spouses in a new way, some got time to spend time with their kids. Some got time to discover new hobbies or restarted old hobbies.

I definitely discovered my love for books and was on a book-finishing-marathon.

A little message for all my friends as we start stepping out of our homes and go back to "Normal".

Be accepting of the fact that the New-Normal is new and it is not the normal that we had known. Be aware we may again have to go back to staying indoors and we best be prepared for it. Example stocking water, medicines, food items, planning your time for work, kids, hobbies.

Don't give up on the yoga sessions that you picked up in the last two years.

Don't give up on the book that has just 99 pages left. After it gets over, don't forget to start the next new one.

Don't give up on meal prepping and depend on ordering out. It could get a ritualistic status as a family activity, where all the family members come together to fix the meal and as they prepare, they exchange chats about how their day had been.

Don't give up on the periodic zoom calls with your friends from college and school.

Don't forget to declutter the wardrobe you had been doing consistently.

Don't feel the need to buy a whole new set of clothes to go to office. Be mindful of what you need and how much you can utilise. (This point alone can be a whole complete blog. Stay tuned to my blog diary-of-a-gypsy-soul.com) Don't give up on watching movies and reviewing it on your blogs or new YouTube channel. What you have to say is a fresh new perspective and it matters.

Don't give up on the sanitizer and mask. It has protected you for so long and it is protection against any other new unknown unseen enemy.

Don't forget to express gratitude towards the delivery boys who came to your door step to help you get your essentials.

Don't feel thankless and frustrated when you don't get a seat in the bus. You got to enjoy your comfy couch for a nice long period of time. Hold of for a few short minutes and you will be back to the comfort of your home.

Don't stop taking the driving lessons because the office cab will be here to pick you. Persevere till you get your license and can confidently drive around the city.

Don't forget to care for yourself just because office is open, schools are open and life in general is in full swing. Take a Monday or any other weekday occasionally just to care for yourself. Get a facial or a pedicure done. Take a look at your finances. See if your SIPs are doing well. Plan your clothes for the next month. Plan your purchases. Utilise the coupons and vouchers that you have hoarded for the longest time. Read a book. Make a chamomile tea. But do it for YOURSELF. Don't forget to tell the people you love - "I LOVE YOU" Don't forget that you survived the pandemic and God has plans for you. You are meant to make this planet a better place.

So, give your Love and KINDNESS freely.

Use your time and energy wisely.

বিলটুর পেন্সিল স্নেহাশিস নিয়োগী বিলটু র মনটা আজ খুব খারাপ। এবারের মাসিক পরীক্ষায়ে খুব বাজে নম্বর হয়েছে তার।বিশেষত বিজ্ঞান আর অঙ্কে। পরীক্ষা যে খুব খারাপ হয়েছিল তা কিন্তু নয়।আসলে কিছু সাধারন ভু লের জন্য এই অবস্থা। অঙ্কে এইসব ভু ল করলে আর রক্ষে নেই। তাদের ক্লাসের নিমাই বাবু সবসময় এই ব্যাপারে তাদের সতর্ক করেন।তবে বিলটুর তার থেকেও বেশি মন খারাপ মা তাকে খুব বকেছে বলে।মা আগে তাকে কখন এত বকেনি।রামনগর হাই স্কু লের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র বিলটু পড়াশোনায়ে ভালই। কিন্তু এবারে চারপাশে তার সাথে খুবই খারাপ হচ্ছে।তাই তার কিছুই ভালো লাগছে না । সামনে আবার সরস্বতী পূজা। প্রতিবার সে মায়ের পূজা ভক্তি ভরে করে।তার তো কত বন্ধু পূজার আগে লুকিয়ে কু ল খায়ে। সে তো কখন খায়েনি ! সে তো তাদের সংস্কৃ ত এর অরবিন্দ স্যার এর শিখিয়ে দেওয়া সেই দুটো লাইন এর মানে সবসময় মনে রাখে আর মেনে চলে – “বিদ্যা দদাতি বিনয়াম,বিনয়াদ ইয়াতি পাত্রনম!”।তু বুও তার সাথেই এইসব হচ্ছে। সে আর ভাবতে পারে না। ঘুমে তার চোখ জুড়িয়ে আসে। বিলটু ঘুমিয়ে পড়লে অনেক রাতে তাদের বাড়ির পিছনের বাগানের আকাশে চাঁদ উঠে। একটা কি পাখি বার বার ডেকে রাত্রির শেষ প্রহরের জানান দেয়। পর মুহূর্তে কিছু একটা দেখে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে পরে। স্বেত শুভ্র বসনা এক নারী মূর্তি কে দেখা যায়ে ওই বাগানে। শুভ্রতার ছটায়ে তাকে স্পষ্ট বোঝা যায়ে না। তবে মন হয় যেন তিনি হাসছেন। কি স্নিগ্ধ্য , কি মমতাময়ী সে হাসি। সেই শুভ্রতা , স্নিগ্ধ্যতা বাতাসে ছড়িয়ে যেন ঝঙ্কার বাজে। কিছু বালক বালিকা কে দেখা যায়ে করজোড়ে নতমস্তকে উপবিষ্ট। দেবী বলেন – “ওরে দেখছিস! আমার ভক্তের মনে যে দুবিধা। যা, তোরা ওকে পথ দেখা!” গ্রামের চণ্ডী মণ্ডপে প্রতি বছর সরস্বতী পূজা হয়। সকাল বেলা হলুদ দিয়ে চান করে , মার ধুয়ে পাট করে রাখা পাঞ্জাবী টা পরে বাবার সাথে বিলটু যায়ে পূজা দিতে। এবারেও তার অন্যথা হয়েনি। শুধু মনটা তার ভারাক্রান্ত। বেরনোর আগে মা বললেন - “কিরে বইগুল নিয়েছিস তো?” বীলটু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।বাবা বললেন – “শুধু বই দিয়ে হবে না। পেন্সিল গুলো নিয়ে চল। মনে রাখবি ওগুলোই তোর প্রধান অস্ত্র।তাই ওগুলোতে শান দেওয়াটা জারুরি।” বিলটুর পেন্সিল গুলো সব ফু রিয়ে এসেছে! বাবাকে সে কথা জানাতে তিনি বললেন – “কু ছ পরোয়া নাহি! যাবার পথে আবির এর দোকান থেকে নিয়ে নিলেই হবে! ” দেখতে দেখতে পরের মাসিক পরীক্ষার সময় চলে এল।আজ সেই বিজ্ঞান পরীক্ষা। বিলটু দের ক্লাস এ পরীক্ষার পর্যবেক্ষক তারাপদ স্যার। তিনিও বিজ্ঞান এর শিক্ষক কিন্তু উঁচু ক্লাস এর। বিলটু দের বিজ্ঞানের শিক্ষক বিমল বাবুর সহৃদয় বন্ধু । দুজনের মধ্যে আরও একটা ব্যাপারে মিল পাওয়া যায়ে। দজুনেই নাম্বার দেওয়ার ব্যাপারে আর পর্যবেক্ষক হিসাবে খুব কড়া ও গোঁড়া। বিমল স্যার এর কম নাম্বার দেওয়ার জন্য স্কু লে সুখাতি এবং ছাত্র দের মধ্যে কু খ্যাতি রয়েছে।তিনি অবশ্য এটা নিয়ে যথেষ্ট গর্ব অনুভব করেন। পরীক্ষা শেষ হবার ঠিক ১৫ মিনিট আগে বিলটু খাতা জমা দিতে এল। সেই প্রথম ছাত্র। স্যার প্রথমে তাঁর হাত ঘড়ি এবং যথাক্রমে ভ্রু কু ঞ্চিত ও ভতস্রনার চোখে বিলটু দিকে তাকালেন।ভাব টা যেন এই জন্য বেটা তোর এই হয়। বিলটু একটু লজ্জিত হয়ে খাতা দিয়ে চলে গেলো। তারাপদ বাবু বিজ্ঞান এর শিক্ষক বলেই হোক বা কিছুক্ষণ সময় থাকার দরুন ই হোক, খাতাটি খুলে অন্য মনস্ক ভাবে দেখছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁর ইন্দ্রিয় গুলি সজাগ হয়ে উঠল। তিনি ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে প্রশ্ন পত্রের সঙ্গে উত্তর মেলাতে লাগলেন। পরে দেখা গেলো ভাব লেস হীন মুখে তিনি ছাত্র দের থেকে খাতা গুলি নিচ্ছেন। তাঁর মুখ মণ্ডলের এই পরিবর্ত ন লক্ষ্য করলো শুধু একটি ছাত্র । সপ্তম শ্রেণির ফাস্ট বয় তথা রাম নগর স্কু ল এর সব থেকে মেধাবি ও শিক্ষক দের স্নেহ ধন্য ছাত্র – কাজল।

টিচার্স রুমে তারাপদ বাবু অধীর আগ্রহে তাঁর বন্ধু র জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন ।তিনি এলে তাকে খাতা টি দেখালেন। কিছুক্ষণ দেখার পর বিমল বাবু আর তারাপদ বাবু একে অন্যের দিকে প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে দেখতে থাকলেন। কাজল তার প্রিয় শিক্ষক কে জিজ্ঞেশ করলো – “স্যার! বিলটু খাতায়ে কি আছে?” বিমল বাবু কাজলের মাথাএ হাত দিয়ে বললেন – “ও কিছু না। তু ই আরও মন দিয়ে পড়াশুনো কর! ফাস্ট টা কিন্তু ধরে রাখতে হবে”। হাই স্কু লের সপ্তম শ্রেণির পরীক্ষার ফল বেরোতেই ধুন্দুমার পরে গেলো। না, ফাস্ট বয় সেই কাজলই। ঘটনাটা ঘটেছে অন্য জায়গাএ। স্কু ল এর ইতিহাসে প্রথম বার কেউ বিমল স্যার এর হাত থেকে ১০০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞান আর অঙ্কে সর্বোচ্চ নম্বর পাপ্ত ছাত্রটির নাম আর কাজল নেই। সবাই কে চমকে সেই জাএগা টি দখল করেছে বিলটু রায় নাম ধারী একটি নতু ন ছাত্র। বিলটুর মা বাবা আজ খুব খুশি।তার মা তার পছন্দের লুচি আর পায়েস রান্না করছেন।তার বাবা গ্রামের লোক জন কিভাবে তাঁর ছেলের সুখ্যাতি করছে সেটা বর্ণনা করছিলেন। হঠাৎ জিজ্ঞেশ করলেন। বাবা – “আচ্ছা বিলটু! তু ই বিজ্ঞান আর অঙ্কে এত নাম্বার পেলি অথচ বাকি গুলো তে বাজে হল কিভাবে? তু ই বাংলা, ভূ গোল এ তো বেশ ভালো তবে ওগুলোতে খারাপ পেলি কিভাবে।” বিলটু - “জানি না বাবা! বুঝতে পারছি না! তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার। সেই যে পেন্সিল গুলো আমি সরস্বতী পুজা তে দিয়েছিলাম না”। বাবা – “হ্যাঁ তো”। বিলটু – “জানো, শুধু অঙ্ক আর বিজ্ঞান পরীক্ষায়ে আমি ওই পেন্সিল দিয়ে লিখেছি।বাকি গুলো তে আমার পুরান পেন্সিল।” বাবা – “কি বলছিস রে! এতো মন্ত্রপুত পেন্সিল মনে হচ্ছে।ম্যাজিক পেন্সিল!” কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন – “ধুর তাই কি হয় নাকি! আর তাছাড়া বাকি পরীক্ষা গুলো ওগুলোতে দিলি না কেন?” বিলটু বলল – “আমি কি করে বুঝব কোনটা কবেকার! এটা তো পরীক্ষার পর টের পেয়েছি। বিলটুর বাবা বললেন – “তাহলে একটা কাজ করি! ওই সব পেন্সিল গুলো তে দাগ দিয়ে রাখি যাতে তু ই পরের বার ওই পেন্সিল গুলো দিয়েই পরীক্ষা দিস। তাহলে বুঝব।” সমস্ত অবাস্তব কে বাস্তব করে পরের পরীক্ষায়ে দেখা গেলো যে যে পরীক্ষায়ে বিলটু ওই দাগ কাটা পেন্সিল দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে তার সব কটাতে সে প্রথম হয়েছে।একেবারে কাজলের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস পরতে থাকলো তার । আর কাউর বুঝতে বাকি রইল না যে ওই পেন্সিল গুলো ভয়ানক মন্তপুত। দেবী সরস্বতীর আশীর্বাদ আছে ওতে। দেখতে দেখতে এই কথা গ্রামে দাবানলের মত ছড়িয়ে গেলো । সবাই এই কথাই বলতে লাগল ।বীলটু বন্ধু রা তাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল। এমনকি তাদের বাড়িতে ওই পেন্সিল দেখতে লোক আস্তে লাগল। এইভাবে চলতে চলতে বার্ষিক পরীক্ষা আসন্ন হয়ে পড়ল। আজ আবার বিজ্ঞান পরীক্ষা। ঘরে তারাপদ আর বিমল স্যার পালা করে ঘুরে গেলেন।বিমল বাবু তো টুকলি দেখার মত বিলটুর পেন্সিল টা বার কতক ঘুরিয়ে দেখে শেষে কালো মুখে রেখে দিলেন। বিমল বাবু ঘর থেকে বেরোতেই কাজল বাইরে যাওয়ার নাম করে বিমল বাবুর পিছু নিল। তাকে জিজ্ঞেস করলো – “কি দেখলেন স্যার!” বিমল বাবু বিকারগ্রস্থের মত শুধু বললেন – “দাগ কাটা পেন্সিল!” গুরু শিস্য অসীম শূন্য টা নিয়ে কোন এক অজানা ভবিষ্যতের কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে দাড়িয়ে রইলেন। পরীক্ষার পর একদিন রাতে বিলটু মার পাশে শুয়ে ছিল।মা তার মাথায়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিছিলেন। বিলটু বলল – “মা একটা কথা বলব তোমায়ে?” মা বললেন – “হ্যাঁ বল!” বিলটু – “মা তোমার মনে আছে সেই সরস্বতী পুজার আগে তু মি একদিন আমায়ে বকেছিলে আর আমি খুব কেদেছিলাম?” মা – “হ্যাঁ!”

বিলটু – “জানো সেদিন রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম! একটা পাঠ শালায়ে খুব সুন্দর একটা ছেলে পড়ছে। তার শরীর থেকে যেন রশ্মি বেরোচ্ছে। কিন্তু তার বন্ধু রা তাকে খেপাচ্ছে, হাসছে! কিছুক্ষণ পরে সেই ছেলেটি ধীরে ধীরে গুরু মশাই কে তার লেখার খাতাটি দেয়। গুরু মশাই খাতাটি দেখে তাকে জিজ্ঞেস করে যে সে এমন লেখা শিখল কি করে । তখন সেই ছেলেটি বলল অভ্যাস করে।তারপর গুরু মশাই তাকে কিছু কঠিন প্রশ্ন করলেন। ছেলেটি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকলো ।গুরুমশাই এর মুখে হাশি ফু টে উঠল ।তিনি তার মাথাএ হাত দিয়ে তাকে বসতে বললেন ।বাকিদের ধমক দিয়ে বললেন দেখ ও কি উন্নতি করেছে। তোদের থেকে অনেক অনেক এগিয়েছে। আজ থেকে ওই এই পাঠশালার মনি।উন্নতির , পরিবর্ত নের একটাই মন্ত্র – পরিশ্রম! বুঝলি ।” বিলটুর শেষ কথা গুলো ঘুমে জড়ান। তার মাও ঘুমন্ত। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বিলটু আবার বলল – “মা ঘুমালে নাকি?” তার মা বলল – “না তবে ঘুম পাচ্ছে!”। বিলটু বলল – “মা যেন একটা কথা আমি কাউকে বলিনি। ওই সরস্বতী পূজার পেন্সিল গুলো আমার কবেই হারিয়ে গেছে। এই গুলো আমি পরে আবির কাকার দোকান থেকে টিফিন এর পয়সা দিয়ে কিনেছি।” তার মা অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন! কিন্তু মার মন তো, বুঝতে অবকাশ মাত্র। সিদ্ধির মুল মন্ত্র যে একান্ত্য পরিশ্রম , এ যে তাঁর ছেলে বুঝেছে এটা ভেবে তাঁর চোখে জল এল। তিনি ছেলেকে কাছে দেখে মাথা এ হাত বুলিয়ে বললেন – “এবার ঘুমো!” পরদিন বিলটুর বন্ধু রা হইহই করতে করতে তার ঘরে এল। সবাই পেন্সিল দেখতে চায়ে। কাজল গম্ভীর মুখে পেন্সিল দেখে বিলটু কে বলল – “তোর পরীক্ষা কেমন হয়েছে!” বিলটু বলল – “ওই একি রকম!” বিলটু মা সবাই বললেন এই তোরা বাড়ি যাস না কেউ। আজ এখানেই সবাই লুচি, আলুরদম আর পায়েস খাবি। তাই শুনে সবাই আরও খুশি হয়ে হই হল্লা করতে লাগল। যথা সময়ে বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরল । একেবারে কোন ঘটনার ঘনঘটা ছাড়াই। আবির এর দোকানের সামনে দিয়ে কিছু উঁচু ক্লাস এর ছাত্র গোলমাল পাকাতে পাকাতে যাচ্ছিল। আবির একটি চেনা মুখ দেখতে পেয়ে দোকানের বাইরে এসে জিজ্ঞেস করলো – “এই শোন! এবার তোদের স্কু ল এর সপ্তম শ্রেণীতে কে ফাস্ট হয়েছে রে?” ছেলে গুলো শুধু উঁচু ক্লাস এই পড়ে না, এক একটা উঁচু দরের ডেঁ পো।যেতে যেতে চিৎকার করে বলে গেলো –“রামনগর হাই স্কু ল এর সপ্তম শ্রেণির এবারের ফাস্ট বয় – বিলটুর পেন্সিল”!

।।সমাপ্ত।।

ক্যাশ্মিয়ার প্রিয়দর্শিণী সেনগুপ্ত ৬ই জানুয়ারি ২০২২ দেখতে দেখতে দিনটা এসে গেল। আর প্রত্যেক বারের মত এবারেও নিজের জন্মদিনের কথা চন্দ্রীমার মনে ছিল না। সকালে আপিসে বেরুনোর আগে মার হাতে পায়েসের বাটি দেখে মনে পড়ল। নানান আজগুবি চিন্তা এসে মনে ভীড় করেছে আজ। অফিসের কাজে তাই মন বসছে না কিছুতেই। একটা নামী বিজ্ঞাপন সংস্থায় চাকরি করে চন্দ্রীমা। সবাই এখানে ত্রিশের নিচে। এবং নিজেদের সাজ পোশাক নিয়ে যথেষ্ঠ সচেতন। কোনরকম গাফিলতি তা সাজেই হোক বা কাজেই হোক এখানে বরদাস্ত করা হয় না। শুধু চন্দ্রীমার ব্যাপারটা আলাদা। সাজপোশাকে কোন নতু নত্ত্ব নেই। হাতে গোনা তিনটে সোয়েটার আর একটা জ্যাকেট আছে। সোয়েটারগুলো বহু পুরনো হলেও জ্যাকেটটা গত বছর সরোজিনি মার্কে ট থেকে কেনা। একটু বেশি শীত পড়লে পরা হয়। দিল্লীতে এই সময় ভীষণ শীত পড়ে। যেমন আজ পড়েছে। এই কোম্পানিতে আজ পনের বছর ধরে কাজ করছে চন্দ্রীমা। বলা যেতে পারে এদের গোড়াপত্তন থেকেই ও আছে। নিজের অসম্ভব কর্মদক্ষতার পরিচয় ও বারবার দিয়েছে। এখানে creative director এর পদে এখন ও আসীন। আজ সকালে একটা ঘটনা ঘটেছে সেই থেকেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে আছে চন্দ্রীমা। কিছুদিন আগে একটা বিদেশী winterwear কোম্পানীর সাথে ওদের কন্ট্রাক্ট হয়েছে। ক্লায়েন্ট নিজেদের ব্র্যান্ড ইন্ডিয়াতে লঞ্চ করতে চায়, কিন্তু ওদের চাহিদা একটু অন্যরকম। কোন নামীদামী মডেল ছাড়াই ওরা এমন একটা বিজ্ঞাপন চাইছে যা সহজেই পথ চলতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। ওদের চাই মধ্যবয়স্ক সাধারণ একটি মহিলা যাঁকে ওদের পোশাকে লাগবে অতু লনীয়া। মুশকিলটা হল ওই মিটিংইয়ে প্রিয়াঙ্কা বলে একজন ক্রিয়েটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল (২৬-২৭ বছর বয়সী, যার কাজে চন্দ্রিমা আগের সপ্তাহে তিনটে ভু ল পেয়েছে) । এহেন প্রিয়ংকা একঘর ক্লায়েন্ট আর চন্দ্রীমার নিজস্ব টিমের সামনে ফস করে বলে বসল, “আপনাদের ডিম্যান্ড তো হুবহু আমাদের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর এর ভাবমূর্তি র সাথে মিলে যাচ্ছে। মধ্যবয়স্ক তো বটেই তবে সবচেয়ে বড় কথা আমরাও ওনাকে এই পুরনো কটা পোশাকে দেখে দেখে টায়ার্ড । আপনাদের নতু ন কালেকশনে ওনাকে কেমন লাগে তা আমরাও দেখতে ইচ্ছুক।“ মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠলেও বয়সের সাথে সাথে একটা ধৈর্য্য এসেছে চন্দ্রীমার। সটান ওর দিকে তাকিয়ে চন্দ্রীমা বলে “গত সপ্তাহে শুনলাম তোমার ক্রেডিট কার্ডে র বিল মেটাবার জন্য কোম্পানি থেকে বোনাস আগেই চেয়ে নিয়েছ তু মি। যার নিজের finance র কোন ঠিকঠিকানা নেই সে বসের জামার খোঁজ রাখে কোন সাহসে?” বলাই বাহুল্য মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে চুন হয়ে গেছিল। কিন্তু চন্দ্রীমার মনে সেই থেকে একটা অব্যক্ত কাঁটা ফু টতে থাকে। কেননা ওই মিটিংয়ে আরেকজন উপস্থিত ছিল। বিশ্ব বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার সারণ্য চ্যাটার্জি। পনের বছর আগে যখন সারণ্যের সাথে ওর পরিচয় হয়েছিল। তখন তার কাছে একটা ক্যামেরা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। মনে আছে ইন্টারভিউয়ের দিনে ১২ জন ক্যান্ডিডেটদের মধ্যে ওরা দুজন খালি বাঙ্গালী ছিল। সবাই টেনশনের মধ্যে থাকলেও সারণ্য সারাদিন দু চারটে ছবি তোলা ছাড়া আর কিছুই করেনি। হাতেও কোন বই বা কাগজ ছিল না। মাঝে তাকে ২-৩ ঘন্টা হাত পা ছড়িয়ে সোফায় ঘুমিয়ে নিতেও দেখেছিল চন্দ্রীমা। শেষে আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল “আপনি এত নিশ্চিন্ত কিভাবে?” একগাল হেসে ভদ্রলোক বলেছিলেন “আমার এই ক্যামেরা ছাড়া কিছুই হারাবার নেই তাই। আপনারা সব বিশাল বিশাল ডিগ্রীধারী, আর আমি খালি ছবি তু লতে জানি। হাহা।“ শুনে আশ্চর্য্য হয়ে যায় চন্দ্রীমা। কারুর জীবনদর্শন যে এত ঘুরপ্যাঁচহীন হতে পারে ভাবা যায় না। আরেকটা খটকা লাগতেই জিগ্যেস করা “আপনি কি পোস্টের জন্য আবেদন জানাতে এসেছেন?”

লোকটি তেমনি সরলভাবে বলে “কেন? সবাই যে জন্য এসেছে। Wedding photographer হওয়ার জন্য।“ মুহুর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায় বুদ্ধিমতী চন্দ্রীমার কাছে। কথা না বাড়িয়ে বলে “আপনি যে ছবিগুলো তু লেছেন দেখান তো।“ খুশী হয়ে ক্যামেরা খোলে সরল মানুষটা। চন্দ্রীমা দেখে সত্যি প্রতিভা আছে সারণ্যের। একটু আনকোরা ঠিকই কিন্তু ইন্টারভিউ দিতে আসা সাধারন কিছু মানুষের এমন সব ছবি তু লেছে ও যা দর্শকের মনে কৌতু হল সৃষ্টি করে পুরো গল্পটা জানার। কিন্তু সত্যি কথাটাও ওনাকে জানানো প্রয়োজন। তাই ভণিতা না করে সরাসরি বলে ও “দেখুন আপনার ভগবান প্রদত্ত একটা ক্ষমতা আছে। সাধারন জিনিসের মধ্যে অসাধারনত্ত্ব খুজে পাওয়ার ক্ষমতা। এটাকে নষ্ট হতে দেবেন না। আর একটু সজাগ হন। সকাল থেকে এখানে বসে আছেন, কারুর হাতে ক্যামেরা দেখেছেন? এই কোম্পানিটা পারেখ ব্রাদার্স নামক জনৈক গ্রুপের সিস্টার কন্সার্ন। ওদের বাড়ির এক ছেলে আশুতোষ পারেখ বিলেত থেকে মাস তিনেক আগে মাসমিডিয়ার ডিগ্রী নিয়ে এসেছে। এক সপ্তাহ আগে এই কোম্পানির গোড়াপত্তন হয়েছে তাই মাইনে আর কম্পিটিশন দুটোই একটু কম। লাঞ্চের আগে accountant দের ডাকা হয়েছে, লাঞ্চের পর আমাদের মানে ক্রিয়েটিভ অ্যাসিস্ট্যান্টদের হবে। আপনাকে বাদ দিলে আমাদের ১১ জনের মধ্যে ওরা ৪ জনকে বেছে নেবে। এবার আপনার কথায় আসি। আমার অনুমান হল আপনি এই বিল্ডিঙের নিচে সোনালী স্টুডিয়োর বিজ্ঞাপন দেখে এসেছেন। ওদের অফিসটা এর উপরের ফ্লোরে। আপনি গত সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে এখানে বসে আছেন। লাঞ্চে বাইরে যেতেও দেখলাম না। না খেয়ে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন। চারদিকে Adwere লেখাটা কি একবারও চোখে পড়েনি? এখন উঠে কোথায় যাচ্ছেন? সোনালীর ইন্টারভিউ অনেকক্ষণ আগে শেষ হয়ে গেছে। তবে তার থেকে বড় সুযোগ ভগবান আপনাকে করে দিয়েছে আজ। আমি একটা প্রস্তাব দেব শুনবেন?” সারণ্যের মুখে তখন আষাঢ়ের মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। দেখে চন্দ্রীমার একটু মায়া হল। বলল “আমি যা শেখাব তাই বলবেন। একটা বেশী কথা বলবেন না। আর এই ছবিটা ওদের দেখাবেন। কেমন? আমি আপনার ইন্টারভিউ শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করব। আপনি তো পাহাড়গঞ্জে ভাড়া থাকেন। আমার বাড়ি কনউট প্লেসে। আমাকে ড্রপ করে তারপর যাবেন।” ভদ্রলোকের ক্যামেরাটা টেনে নিয়ে ছবিটা দেখায় চন্দ্রীমা। গলায় টান পড়তে হুমড়ি খেয়ে একদম ওর ঘাড়ের কাছে এসে পড়ে সারণ্য। সত্যি এত ঘন চোখের পাতাও কারুর হয়। চশমা পরে থাকে বলেই কি আগে কিছু বোঝা যায় নি? এই মেয়েটার মধ্যে একটা স্বতন্ত্রতা আছে। যা আজকের যুগে বড়ই বিরল। অবাক হয়ে চেয়ে থাকে সারণ্য। আরও কিসব বলছিল মেয়েটা। সেগুলো আর শোনা হয় না সারণ্যের। ইন্টারভিউ দিয়েই চন্দ্রীমা বুঝতে পারে এই চাকরি সে পাচ্ছেই। এর আগে দুবছর সে Oliveries এর মত নামী বিদেশী কোম্পানিতে সে চাকরি করেছে। তাছাড়া দিল্লী ইউনিভার্সিটির Mass Communication and Creative Journalism এর কৃ তী ছাত্রী সে। এই পারেখদের মত ছোট কোম্পানি তো তাকে লুফে নেবেই। ওদিকে ভিতরে চন্দ্রীমার কথামত সারণ্য ওই ছবিটা দেখায় যেখানে “Adwere” কথাটা মাকড়সার জালের মধ্যে দিয়ে দেখলে “Adhere” মনে হচ্ছে। কোম্পানির মোটো “Seeing your imagination” এর সত্যি প্রতিফলন এটা। রাত আটটার সময় পারেখজির সাথে খোশগল্প করতে করতে বেরিয়ে আসে সারণ্য। বাইরে তখনও অপেক্ষা করছে চন্দ্রীমা। ট্যাক্সি করে ফেরার সময় চন্দ্রীমা সারণ্য সম্বন্ধে সবই জানতে পারে। চাকরিটা ওরও খুব প্রয়োজন। আজ সারাদিন বেচারাকে উপোস দিতে হয়েছে কেননা পকেটে বাসভাড়া ছাড়া কিছুই নেই। পাহাড়গঞ্জে খুবই কষ্ট করে একচালার একটি ঘরে থাকে সারণ্য। আজ এই চাকরিটা না পেলে সম্পূর্ণ আশ্রয়হীন হতে হবে তাকে। যদিও তার পরিবার কলকাতার আদি বড়লোক পরিবার গুলোর অন্যতম তবু ব্যাবসার কাজে কোনকালেই মন বসত না সারন্যের। বাবা, দাদা এরাই সমস্ত বাণিজ্য দেখাশুনো করত। পড়াশুনোতে সে কখনও ভাল ছিল না। তাই গ্র্যাজুএশন পাশ করেই মার একটা হার আর দুটো বালা সম্বল করে ছুটে এসেছিল দিল্লীতে। এখানে Delhi College of Photography থেকে স্টার মার্ক্স নিয়ে পাশ করলেও গত তিন মাস ধরে চাকরির কোন হদিস নেই। আজকাল বাবার কথাই সত্যি হতে শুরু করেছে। নিজেকে অপদার্থ আরা কু লাঙ্গার মনে হয়। মার গয়নাটার জন্য তার মনটা সবচেয়ে বেশী ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। তাই কলকাতা যাওয়ার কথা মাথায় আসলেও কিছুতেই তা কার্যকর করতে পারে না সে। চুপ করে সমস্ত শোনে চন্দ্রীমা। শেষে বলে “চিন্তা নেই। চাকরিটা আপনি পাচ্ছেন।

তবে মাইনে নিয়ে একটু দরাদরি করবেন। ওরা পঁচিশ অফার করলেও। আপনি তিরিশের নিচে রাজি হবেন না।“ বিস্ময়ে চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে সারণ্যের “পঁ …পঁচিশ হাজার। আবার তিরিশ চাইব?”

“হুম, চাইবেন। পরবর্তীকালে আপনি এই কোম্পানির অ্যাসেট হবেন। এখন চলুন আমাদের বাড়িতে ডিনার সেরে যাবেন। শেষ বাস রাত সাড়ে দশটায় ছাড়ে। ওটায় চেপে দিব্যি বাড়ি পৌঁছে যেতে পারবেন। এখন নামুন।“ সেদিন চন্দ্রীমাদের বাড়িতে রাতের খাবার খেয়েছিল সারণ্য। ফেরার সময় শুধু অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেছিল “কিভাবে যে আপনার এই উপকার……“ তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে চন্দ্রীমা বলেছিল “পৃথিবীতে কোনকিছুই ফ্রি না। আপনি একদিন আমায় পঁাচ তারা রেস্টুরেন্টে ডিনার করাবেন। কেমন?“ সেই একই রকম সরল হাসি হেসে ও বলেছিল “Definitely”। রাতে দিদির পাশে শুয়ে সপ্তদশ বর্ষীয়া অরুণিমা জিগ্যেস করেছিল “হ্যাঁ রে দিদি, তোর এই লোকটাকে ভাল লেগেছে নারে? তু ই তো আজ পর্যন্ত্য কারুর জন্য এত করিসনি, তাই ভাবলাম……।“ ডায়েরি লিখতে লিখতে মুখ তু লে তাকায় চন্দ্রীমা। চিরকালই সে স্বল্পভাষীনি। আজ সারাদিনে সে যত কথা বলেছে একবছরেও এত বলে না। তাই বোনের অস্বাভাবিক লাগারই কথা। সেদিন চন্দ্রীমা ডায়েরিতে লিখেছিল “আজ একটা লোকের সাথে দেখা হল। কোনদিন যদি বিয়ে করি তবে ……”। কথাটা ডায়েরির কাছেও স্বীকার করতে কু ণ্ঠা হয়েছিল চন্দ্রীমার। এরপর কেটে গেছে দু বছর। সারণ্য চ্যাটার্জি আর Adwere দুইই মিডিয়া জগতে ভীষণ জনপ্রিয়। বিভিন্ন মডেলিং এজেন্সি, ফু ড চেন, ম্যাগাজিন সবার এদেরকে প্রয়োজন। সারণ্যের ছবিতে চেনা মডেল হয়ে ওঠে অভীনব। ওর ক্যামেরা গলায় ঝোলানো সাদা জামা আর নীল জিন্স পরা ফটো Adwere এর ব্র্যান্ড ইমেজ। এদিকে এমপ্লয়ী হিসেবে চন্দ্রীমারও ভীষণ নামডাক। যেকোন প্রোজেক্টকে Perfection এর চূড়ান্তে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই সিরিয়াস চেহারার বাঙ্গালী মেয়েটা। তাই অল্প বয়সেই সে টিম লিডের সুযোগ পেল। চন্দ্রীমাও ভীষণ তৃ প্ত। তার আগের কোম্পানিতে এই অনমনীয় ব্যাবহারের জন্য তাকে কম ভোগান্তি পোষাতে হয়নি। সমবয়সী কলিগদের কাছে প্রতিদিন হেনস্থা হতে হত। শেষে একদিন তার বস বলল একটি সহকর্মীনির নাকি তার সমালোচনা শুনে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে। বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। সেই শনিবার ডিফেন্স কলোনিতে ওই মেয়েটির বাড়ি গিয়ে চন্দ্রীমা দেখে বড়লোকের আদরের দুলালী পায়ের উপর পা তু লে টিভি দেখছেন। তবু তাকে সরি বলে চন্দ্রীমা। কিন্তু মেয়েটা ওর কাছে Written Apology চায়। চন্দ্রীমার জন্য নাকি তার কাজ ক্লায়েন্টের পছন্দ হয়নি। ব্যাগ থেকে নোটপ্যাড বের করে তখনি লিখে দেয় ও “I sincerely apologize to myself for bearing with such airheaded bimbos”। ব্যাস পরের দিনই রেসিগনেশন আর নতু ন চাকরি খোঁজা। ঝট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া চন্দ্রীমার ধাতে নেই। কিন্তু সেদিন রোখ চেপে গেছিল। নতু ন টিম লিড হওয়ার পর প্রথম যে প্রজেক্টটা চন্দ্রীমাদের টিমের হাতে আসে তা হল একটা উঠতি কস্মেটিক্স ব্রান্ডের বিজ্ঞাপন। এক সপ্তাহ ধরে কাউকে বাড়ি যেতে দেয়নি চন্দ্রীমা। সবাই পরিশ্রান্ত কিন্তু এখনও কিছু ফাইনাল হয়নি। সবাই মিলে ধরল সারণ্যকে। একমাত্র সেই পারে চন্দ্রীমাকে বোঝাতে। শুক্রবার দিন রাত আটটার সময় চন্দ্রীমার কেবিনে হাজির হল সারণ্য। তখনও সে ছবি গুলো দেখে চলেছে। মুখ তু লে সারণ্যকে বলল “আপনি খ্যাতির চুড়ায় উঠে কাজ ভু লে যাচ্ছেন। ছবি গুলো বড্ড বোরিং।“ একটু অপ্রস্তুত হয়ে সারণ্য বলল “সোমবার কি দেখাবেন ক্লায়েন্টকে?”

-“আপনি সব কটা ছবি জমা দিয়েছেন?”

-“হ্যাঁ। ওতেই সব আছে।“ -“ছবিতে এই বাচ্চাটা কে?”

-“সুপার মডেল সোফিয়া শিনয়ের মেয়ে।“ -তাকে ফ্লোরে কেন এলাউ করেছেন?” একটু বিরক্ত লাগে সারণ্যের। বলে- “আমার স্টুডিও ফ্লোরে আমি কাকে এলাউ করব আশা করি সেই স্বাধীনতা আমার আছে। “ -“আপনার তো কাজ শেষ। এতক্ষণ বসে আছেন কেন?”

-“আমি রোহিণী আর সুজাতাকে লিফট দেব বলেছি।“ -“ আমার স্টাফেদেরকে ছাড়া বা আটকে রাখার দায়িত্ব আমার। সুতরাং যখন দরকার পড়বে আমি ড্রাইভার ডেকে নেব।“

এরপরে আর কথা বাড়ানো চলে না। অতএব সেই রাতে মানে মানে বাড়ি ফিরে এসেছিল সারণ্য। তারপরদিন রাত সাড়ে তিনটেয় যখন ফোন এসেছিল চন্দ্রীমার তখন সে ঘুমে অচৈতন্য। তাকে অবাক করে দিয়ে চন্দ্রীমা বলেছিল “এখন ড্রাইভারের প্রয়োজন, চলে আসুন। সুজাতা আর রোহিণী অপেক্ষা করছে।“ ভীষণ রাগ হয়েছিল সারণ্যের। কিন্তু এক সপ্তাহের বিনীদ্র জাগরণ বৃথা গেল না। শেষ পর্যন্ত্য যে বিজ্ঞাপনটা দিল্লী সহ দেশের সমস্ত বিলবোর্ড রাতারাতি কব্জা করে নিল সেটি শুধু দুটো ছবি। ওপরের ছবিটি সুপার মডেল সোফিয়া লাল গাউন পরে লাল লিপস্টিক লাগাচ্ছেন। তার নিচে লেখা “Aqua – Chemical Free Products which are safe for her… " আর নিচের ছবিটিতে একি ভঙ্গিমায় একটা বছর পাঁচেকের মেয়ে লাল ফ্রক পরে মার অনুসরণ করে অপটু হাতে আয়নার সামনে লিপস্টিক লাগাচ্ছে। এবং তার নিচে লেখা "and her too……”। চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। সারণ্যের বিজয়রথ সেখান থেকেই শুরু। কিন্তু ওই ড্রাইভারের ঘটনাটা তার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। একদিন কিছু কলিগের সামনে হেসে বলেছিল “ওকে চন্দ্রীমা না বলে চন্ডী বলে ডাকাই ভাল। বাপ্ রে কি টেম্পার“। বিধি বাম। কথাটা চন্দ্রীমাও শুনে ফেলে। এরপর বহুবার সারণ্য চেষ্টা করেছে কথা শুরু করার। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। এরপর কেটে গেছে বহু বছর। সারণ্য বহুদিন আগেই নিজের স্বপ্নকে সত্যি করতে পেরেছে। জোরবাগে নিজস্ব চারতলা বাংলোর নিচের ফ্লোরে বিশাল স্টুডিয়ো । এই তো তিনমাস আগে মিলান ফ্যাশন উইক কভার করে এল ও। দেশের গোঁরব সারণ্য চ্যাটার্জি। আগের মাসে ৬ই ডিসেম্বর জন্মদিন ছিল ওর। বিদেশ থেকে ৫ জন ফোটগ্রাফার এসে ২ সপ্তাহ ধরে ট্যুর করে গেল ইন্ডিয়াতে। পুরোটাই স্পন্সরশিপে। মাকে হার, বালা ছাড়াও নিউ ইয়র্কে র Tiffany থেকে এনে দিয়েছে solitaire diamond ওয়ালা কানের দুল। বাবা পর্যন্ত্য আত্মীয় স্বজন সবার কাছেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। খালি একটাই দুঃখ সবার “চল্লিশ বছর বয়স হল, কিন্তু এখনও ছেলেটা বিয়ে করল না।“ তাতে অবশ্য সারণ্যের ভ্রুক্ষেপ নেই। জীবনটা এই ভাবে নির্ঝঞ্ঝাট কেটে গেলে মন্দ কি? কিন্তু আজ সকালের ঘটনাটা ওকেও বড় নাড়া দিয়েছে। নাঃ, বহুদিন পর আজ তার সাথে একবার দেখা করতেই হবে। এদিকে চেম্বারে বসে চন্দ্রীমা ভাবছে রেজিগনেশন দেওয়াটা ঠিক হবে কিনা। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে আজ ৮ বছর হল। বাবাও গত হয়েছেন বছর পাঁচেক আগে। শুধু মা আর ও। যা টাকা জমেছে বাকি জীবনটা হেসে খেলে কেটে যাবে। তবে? মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আসলে কাজটাকে ভীষণ ভালবাসে চন্দ্রীমা। এতগুলো বছর ধরে নিজের ধ্যান জ্ঞান সমস্তই এই কোম্পানি। এদিকে ক্লায়েন্ট ও চেপে ধরেছে ওদের মডেল হিসেবে চন্দ্রীমাকেই চাই। ডিসাইনারের মতে এটা নাকি একটা ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া। কিন্তু নিজের ছবি সারা পৃথিবীময় করতে ভীষণ আপত্তি ওর। এহেন পরিস্থিতিতে কি করা যেতে পারে? এর থেকেও বড় প্রশ্ন যেটা আজ মনের মধ্যে বারবার উঁকি দিচ্ছে সেটা হল সত্যি কি তবে বুড়িয়ে গেল সে? আজ তার ৪০তম জন্মদিন। তবে কি তার জীবনে একটা অপূর্ণতা রয়েই গেল? প্রথমবার কাউকে দেখে নতু ন কিছু শুরু করার ইচ্ছা জাগলেও সেই ইচ্ছাকে তো সে নিজেই নির্মূল করেছে। তাছাড়া আকাশের ধ্রুবতারাকে চাওয়ার মতো মূর্খামি আর নেই। সেটাও সে জানে। তবে কিসের আক্ষেপ? ঠিক তখনই যাকে নিয়ে এত চিন্তা ভাবনা সেই ভদ্রলোক হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকলেন। একটু চমকে গেলেও যে কথাটা চন্দ্রীমার মনে প্রথম এল সেটা হল ও তো এখনও একি রকম সুন্দর আছে। বরং বয়সের সাথে সাথে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে ওর লাবণ্য । ছ ফু ট চেহারা, ফর্সা রঙ রোদে ঘুরে ঘুরে তামাটে হয়েছে, কালো ঘন চুল আর জুলপিতে একটু পাক ধরলেও হাসিটা সমান দীপ্তিময়। শুধু এখন হাসলে চোখের পাশের চামড়া কুঁ চকে ওঠে আর চেনা দুই চোখে সময়ের প্রতিফলন ধরা পড়ে। কি যেন বলছে লোকটা, জোর করে মনটাকে টেনে আনে চন্দ্রীমা।

“……এই প্রস্তাবে আপনি রাজি হবেন কিনা তা আপনার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আজ পর্যন্ত্য কোন যুদ্ধে আপনাকে পিছুতে দেখিনি আমি। তাই আমার সবসময় মনে হয় আপনি অনন্য শক্তির অধিকারিণী। আমার এই ধারণাটাকে সামান্য কটা কথার জন্য ভু ল প্রমাণ করবেন না।“

এতটা বলে সারণ্য উঠে চলে যাচ্ছিল। চন্দ্রীমা হঠাৎ পিছন থেকে ডেকে বলল “সামান্য কথা। আপনার সামান্য একটা কথার জন্য সবাই আমাকে চণ্ডী বলে ডাকে। কেন আমি আপনার কি ক্ষতি করেছিলাম?” খানিকক্ষন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সারণ্য। তারপর চন্দ্রীমাকে অবাক করে দিয়ে হাহা করে হেসে গান গেয়ে ওঠে। “তু মি কোন কাননের ফু ল, কোন গগনের তারা, তোমায় কোথায় দেখেছি, যেন কোন স্বপনের পাড়া……তু মি এখনো বুঝলে না। দশ বছর আগে নিউ ইয়র্ক থেকে একটা জিনিস কিনেছিলাম। আজ দশ বছর ধরে তা পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সেদিন তু মি আমাকে আমার জীবনের দিশা দেখিয়েছিলে চন্দ্রীমা, আজ আমার যশ, সাফল্য, অর্থ সবই তো তোমার জন্য। আমার উপর যখন কারুর আস্থা ছিল না তখন তু মিই একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছিলে পাশে। কতবার তোমায় বলতে চেয়েছি কিন্তু আমাদের মধ্যে এই ব্যবধান তো তু মিই তৈরি করেছ। এখন তোমার জিনিস তোমায় দিলাম।“ এতটা বলে টেবিলের উপর ঠক করে একটা চকচকে জিনিস রাখল ও। আরে এটা তো হিরের আংটি। ভিতরে খোদাই করা আছে “Forever my heart”। এত কথা বলে চন্দ্রীমার অভিব্যাক্তি দেখছিল সারণ্য। চন্দ্রীমার মুখে বিস্ময় আর রাগ মেশানো একটা বেগুনী অভিব্যাক্তি। চাপা গলায় বলল “এতদিন ধরে বলেননি কেন? আর এত দামী জিনিসটা এমনি খাপ ছাড়া অবস্থায় পকেটে নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছেন কিসের জন্য?” সারণ্য ছুটে এসে ওর হাত ধরে টানতে থাকে, বলে “চল সেদিনের প্রমিসটা আজ পুরণ করবই। পাঁচ তারা রেস্তুরঁায় বসে তোমার জন্মদিন সেলিব্রেট করব, চলোওওও”। ৬ই এপ্রিল ২০২২ আজ ২ মাস হল দেশের বিভিন্ন শহরে শোভা পাচ্ছে একটি নবাগত বিদেশী কোম্পানির বিজ্ঞাপন। একটা ছবি। এক শীতের সকালে বাইরে ঝাপসা আকাশের দিকে তাকিয়ে আলগা খোঁপা করা গোলাপি সোয়েটার পরে একটি রমণী বসে আছে। দু হাতে ধরা ধূমায়িত কফির কাপ। তার চেহারায় প্রথম যৌবনের লালিমা না থাকলেও আছে অভিজ্ঞতার এমন এক মাধূর্য্য যা ভাষায় বর্ণনা করা মুশকিল। তার চোখে মুখে বুদ্ধিদীপ্ত অথচ আশ্চর্য্য এক কোমলতার আভাস। বঁা আঙ্গুলের অনামিকাতে পরা আছে নিউ ইয়র্কে র টিফানির আংটি। নিচে লেখা “Cashmere – So Strong yet so beautiful”। সেদিন গভীর রাতে ভারতের নিউ দিল্লী শহর থেকে সুদূর আমেরিকায় একটা ফোন গেল“হ্যালো অরু?”

“হ্যাঁ মা বল” “শোন না, দারুণ খবর। তোর দিদির বিয়ে ঠিক হয়েছে। এতদিনে আমার গুরুদেব মুখ তু লে চেয়েছেন। ছেলের বাবা মা দাদা সবাই এসেছিল আজ বাড়িতে। সামনের জুনের প্রথম সপ্তাহতেই বিয়ে। ওরা তাজ ভাড়া করবে বলছিল। তোর দিদিই রাজি হল না। বলল ছেলের বাড়িতে ছোট করে রেজিস্ট্রি সেরে নিতে। ছেলে তাতেও রাজি। কিজে ভাল ছেলেটা তোকে কি বলব। কবে আমার হাতে ডিমের ঝোল খেয়েছিল কত প্রশংসা করল।“ “তা দিদি এখন কি বলছে?” “কিছু না, তোর দিদিকে তু ই চিনিস না নাকি? ওরা চলে যেতেই গম্ভীর মুখে নিজের ঘরে চলে গেল। আমার কিন্তু ছেলেটাকে ভীষণ পছন্দ।“ “দিদিরও সারণ্যদাকে ভীষণ পছন্দ।“ “তু ই কিভাবে জানলি?” “আমি সবই জানি। তু মি এখন ফোন রাখো। আমি এখনি টিকিট কাটছি। তোমার নাতনি আর জামাইকে নিয়ে এই মাসের শেষেই চলে আসব। মাঝে আর একটা মাস। অনেক কাজ বাকি।“

।।সমাপ্ত।।

ভালোবাসা ভাস্কর দাস কবিগুরু লিখেছেন ‘এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো, তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’॥ আজ পয়লা বৈশাখ, অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, নববর্ষ মানেই আমাদের কাছে উৎসব, ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে, বাড়ির সামনে ছিল বিশাল মাঠ, সেই মাঠে বসতো, বিশাল মেলা, বিভিন্ন রকম খেলনা থেকে শুরু করে ছোটখাটো সাজের জিনিস , সবই পাওয়া যেত সেই মেলায়, নববর্ষে পাওয়া নতু ন জামা পড়ে সন্ধ্যেবেলা সেই মেলাতে যাওয়া, সে কি আনন্দ, আরও একটা আকর্ষণ ছিল নববর্ষের, সেটা হল, দুপুরের খাওয়া দাওয়া ॥ কিন্তু এটা কি হচ্ছে আজকে সকাল থেকে, আজ পয়লা বৈশাখ অথচ অন্তত দশবার ওকে ফোন করলাম, রিং যাচ্ছে কিন্তু অন্য দিক থেকে ও ফোন উঠাচ্ছে না ,একটা অজানা আশঙ্কায় বুকটা কাঁপছে । তাহলে কি ও ভীষণ রেগে আছে আমার উপর । রাগ হবে তো বটেই । গত পাঁচদিন ধরে ও এতবার কল করেছে, ক্ষমা চেয়ে ম্যাসেজ দিয়েছে কিন্তু আমি ধরিনি কোন মেসেজের উত্তরও দিইনি । খুব বিরক্ত লাগছে, বিরক্তি আসাটা স্বাভাবিক। রাগ করে গতকাল থেকে ফোন করছে না । যখন ফোনের উপর ফোন করছিল তখন ধরিনি । আর এখন ও ফোন করছে না বলে বুকের কোথায় যেন একটা বেদনা অনুভব করছি । বাধ্য হয়ে থাকতে না পেরে এখন আমিই ফোন করছি । এখন আর ও ফোন ওঠাচ্ছে না । বুঝতে পারছি খুবই অভিমান করেছে ॥ আমার এই ও হল, আমার জীবনের সবকিছু , এই ও কে নিয়ে আমি অনেক স্বপ্ন দেখি । আমি একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করি । মা আর আমাকে নিয়ে আমার পরিবার। বিয়েটা অনেক আগেই সেরে ফেলতাম। কিন্তু একটা ঠিকঠাক চাকরির অপেক্ষা করছি। যে কটা টাকা মাইনে পাই তাতে পরিবার চালাতে হিমশিম খেয়ে যাই। এর মধ্যে আমার ও কে এনে কষ্ট দিতে চাই না। কিছুদিন অপেক্ষা করছি। ভাল চাকরির জন্য খুবই চেষ্টা করছি। কয়েক জায়গায় কথাও হয়েছে। খুব তাড়াতাড়িই ভাল কিছু হবে আশা করি। তখন আমার ও কে আমার কাছে নিয়ে আসব। দূরে থাকলে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে। কাছে নিয়ে আসলে সব ঝগড়ার অবসান হবে, তখন শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা ॥ আমার মা আমার ও কে খুব স্নেহ করেন। ওর সাথে পরিচয় হবার পর ,মায়ের সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দেই। মা ওকে বিশেষ পছন্দ করেন নি তখন। মেয়ের গায়ের রঙ শ্যামলা তাই মায়ের ভাল লাগে নি ॥ মায়ের মুখের ওপর কথা বলি নি সেদিন। মাকে কষ্ট দেই নি। আবার আমার ও কে ও ছাড়ি নি। মাকে কোনভাবে কষ্ট দেওয়া যাবে না। আবার ভালবেসে যার হাত ধরেছি, সারাজীবন একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছি, তার হাতও ছাড়তে পারব না। কয়েকদিন ধরে মাকে বোঝালাম। মা বুঝতে রাজী নন। এদিকে আমার ও কে ও কথাটা খুলে বলতে পারছি না। মেয়েটা কষ্ট পাবে। যেভাবেই হোক মাকে মানাতে হবে। এ নিয়ে একদিন মায়ের সাথে আলোচনায় বসলাম

‘মা, আমরা সবাই সৌন্দর্য ভালবাসি। কিন্তু বাইরের সৌন্দর্যের চেয়ে মনের সৌন্দর্যটা অনেক বেশি জরুরী। যার সাথে আমি সারাজীবন ভাল থাকব, যে আমাকে সারাজীবন ভাল রাখবে, তার বাইরের সৌন্দর্যটা আমার কাছে কোন গুরুত্ব রাখে না। তবুও তু মি যদি ওকে না মেনে নাও, তোমার অনিচ্ছায় আমি কখনও ওকে বিয়ে করব না। তবে হয়ত সারাজীবন আফসোস করব, ‘॥ মনে হল আমার কথা মায়ের মনে ধরেছে। মা চুপ করে আছেন। তার মানে মা ভাবছেন কি করা যায়। আর মা যখন ভাবছেন, তার মানে কাজ হয়ে গেছে ॥ এরপর মায়ের অনুমতি নিয়ে এক সপ্তাহ পরে ওকে আমাদের বাড়ীতে নিয়ে এলাম। মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। এরপর ও মায়ের সাথে ফোনে কথা বলত, খোঁজখবর নিত ছুটির দিনে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসত, নানা রকম রান্না করতো। ওর রকমারি রান্না খেয়ে মা তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ ॥

ধীরে ধীরে ও আমার পরিবারের সবার মন জয় করে নিল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এখন আর মায়ের ওকে নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। এখন শুধু একটা ঠিকঠাক চাকরির অপেক্ষা ॥ এক সপ্তাহ আগে ওকে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ফোন করে, ওর ফোন ক্রমাগত ব্যস্ত পাচ্ছিলাম । ওকে জিজ্ঞেস করাতে ও বলেছিল অফিসে কারো সঙ্গে জরুরী কথা বলছিল । আমি ব্যাপারটা নিয়ে হঠাৎ খুবই রেগে যাই, ও যতবার আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে ও অফিসের কাজের কথা বলছিল ,আমি কিছুতেই শুনিনি বলেছিলাম, ‘এত রাত্রে অফিসের কথা বলতে হবে কেন, দিনের বেলা কি হয়েছে?’ ॥ রাগ করে ফোনটা দুদিন বন্ধ রাখি। দুদিন পর ফোনটা চালু করার সাথে সাথে অনেকগুলা মিসড কল এলার্ট। আর অনেক মেসেজ। তাতে অনেক কিছু লেখা, ফোনে, কথা বলার কারণ ব্যাখ্যা করেছে, ক্ষমা ও চেয়েছে, আমাকে অনেক ভালোবাসে বলেছে কিন্তু তাতেও আমার রাগ কমে নি তারপর আরো অনেকবার ও ফোন করেছে, কিন্তু আমি ওর ফোন ধরিনি ॥ কিন্তু গতকাল থেকে ওর কোন ফোন বা মেসেজ আসছে না কেন? এতদিন চেষ্টা করে আমার রাগ ভাঙাতে পারেনি বলেই কি এবার তা হলে আমার উপর অভিমান করে বসে আছে ?বুঝতে পারছি এবার আমাকেই ক্ষমা চাইতে হবে আমাকেই ওর অভিমান ভাঙ্গাতে হবে, যতই রাগ করে কথা না বলে থাকি না কেন, ভালোবাসাটা তো কমেনি । একটু নিখোঁজ থাকলেই মনটা ছটফট করতে থাকে ॥ অন্তত কু ড়ি বার রিং হওয়ার পর, ওপার থেকে কেউ ফোনটা ধরলো ॥ ‘হ্যালো’ ‘ হ্যালো , হ্যাঁ আমি বলছি, তোমরা সবাই ভালো আছো? তোমার দিদি কোথায়? কখন থেকে তোমার দিদিকে ফোন করছি , কিন্তু তোমার দিদি ফোন ধরছেনা’

‘কে , দাদাবাবু? ’ ‘কি হয়েছে তোমার? তোমার কথা এমন শোনাচ্ছে কেন তোমার দিদি কি আবার তোমাকে বকেছে? ওকে কতবার বলেছি তোমাকে যেন না বকে, ফোনটাকে দাও আমি ওকে ভালো করে বকে দেবো’ ‘দাদাবাবু’ বলতে বলতে কেঁ দে ফেলল ওর ছোটবোন। বুঝতে পারছি না কি হয়েছে। যতই জিজ্ঞেস করছি, ওর ছোটবোন ততই কাঁদছে। হাউমাউ করে কাঁদছে ॥

‘কিছু তো বলো। কি হয়েছে?’ ‘ দাদাবাবু, গতকাল সকালে দিদি এক্সিডেন্ট করেছে’ ‘ কি???? ও এখন কোথায়? কোন হাসপাতালে? ‘বাড়িতে’ ‘বাড়িতে কেন? এক্সিডেন্ট করেছে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাও নি?’ ‘দাদাবাবু আপনি পারলে আমাদের বাড়িতে এক্ষু নি একবার চলে আসুন’ ‘হ্যাঁ আমি এক্ষু নি আসছি’ ॥

মাকে জানিয়ে তাড়াতাড়ি বের হলাম। মিনিট কু ড়ি লাগল ওদের বাড়িতে পৌছাতে। ওদের বাড়িতে ঢুকতেই দেখলাম অনেক মানুষের ভীড়। সবাই কান্নাকাটি করছে। বুকের ভেতর আরও মোচড় দিয়ে উঠল। আমাকে দেখেই ওর মা হাউমাউ করে কেঁ দে উঠলেন। ওর ছোটবোন দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। দূরে একটা খাট দেখলাম। দেখেই আমার দু পা স্থির হয়ে গেল। সামনে এগোতে পারছি না। খাটে কে শুয়ে আছে? ওর মা আর ওর ছোটবোন এত কান্নাকাটিই বা করছে কেন? তবে কি ও??? না না এসব কি ভাবছি। এটা হতেই পারে না ॥ আমি আবার ওর ছোট বোনকে জিজ্ঞেস করলাম যে ওর দিদি কোথায় আর কি হয়েছে ওর দিদির ॥ ওর ছোট বোন অদুরে রাখা খাট টা আমাকে দেখিয়ে দিল। আস্তে আস্তে খাটের কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, খাটের উপর আমার পাগলীটা শুয়ে আছে। পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে । আর কোনদিন ওর ঘুম ভাঙবে না। আমার পা চলছে না। শরীরের শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। মাটিতে বসে পড়লাম ॥ কোনো রকমে নিজেকে সামলে ওর মাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে কি করে ঘটল এমন দুর্ঘটনা, ওর মা বলতে লাগলেন, গতকাল রাস্তা পার হতে গিয়ে একটি ট্রাকের সাথে ওর অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ,খুবই খারাপ অবস্থা ছিল, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল, ওনারা সারাদিন চেষ্টা করে রক্ত যোগাড় করেছিলেন, কিন্তু যতই রক্ত দেয়া হচ্ছিল, রক্তক্ষরণ কিছুতেই থামছিল না, ডাক্তাররা বলেই দিয়েছিলেন যে ওকে বাঁচানো যাবে না তবু চেষ্টা করেছেন ওনারা যদি শেষ রক্ষা হয় কিন্তু সেটা আর হলো না , আজ ভোরে চলে গেল ওনার মেয়ে , কান্নায় কথা বলতে পাচ্ছিলেন না উনি, ওনার কান্না থামানোর শক্তি আমার নেই ॥ চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সে হয়তো আমার কথা ভেবেছে। হয়ত আমাকে খুঁজেছে। একটিবার কথা বলতে চেয়েছে॥ ওর সাথে আমার শেষ দেখা হলো না, শেষ কথাটা আর বলা হলো না শেষবারের মতো বলতে পারলাম না যে আমি ওকে খুবই ভালোবাসি ॥ আজ পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, আমার প্রাণের মানুষের অন্তিম পয়লা বৈশাখে, তার পার্থিব শরীর কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলেছি সেই স্থানের দিকে যেখানে তার শরীর পঞ্চভূ তে বিলীন হয়ে যাবে, হঠাৎ কে যেন আমার কানের কাছে খিলখিল করে হেসে বলে উঠলো ‘কি, বাবুর রাগ কি কমেছে এখন?’

।।সমাপ্ত।।

গৃহী মৈত্রী মৈত্রী প্রামাণিক ঘর মানেই প্রাণের জায়গা- স্বপ্ন দেখার স্থান। যেখান থেকে শুরু হয় এক রঙিন দিন আর যেখানে শেষ হয় সারাদিনের ক্লান্তি। সেই ঘরের ছোট ছোট কণার যদি সাজানো হয় ন্যূনতম খরচায়, তাহলে তো কথাই নেই। ঘরকে আরও সুন্দর করতে, আরও রঙিন করতে আমরা ব্যবহার করতে পারি কিছু ইনডোর গাছ ।যেমন- মানিপ্ল্যান্ট।

06.

দামেও কম এবং যত্ন প্রায় না নিলেও এই গাছ আপনার ঘরের শোভা বাড়াতে সক্ষম। আর টব হিসেবে যদি ব্যবহার করেন একটি ছোট ঝু রি তাহলে তার সৌন্দর্য মাত্রা আরও একটু বেড়ে যায়। আবার কখনোবা আর্টিফিশিয়াল গাছও সাধারণ দেওয়ালের লুকস বদলে দিতে পারে।

যেখান থেকে শুরু হয় এক রঙিন দিন আর যেখানে শেষ হয় সারাদিনের ক্লান্তি।

চঞ্চল পলাশ ও কবিতা নীলা অধিকারি পলাশ যখন চঞ্চল হল তখনি দূরে সন্ধ্যার মৃদু পদচারনা সমস্ত নীল আকাশটাকে লালে লাল করে দিয়ে এক অজানা অচেনা পাখির ডাক চুরি করে নিয়ে গেছে মন কেমন করা বিকেলের রংটুকু । জাগো চঞ্চল পলাশ, গোপনে তোমার থেকে সামান্য কিছু রঙ নিয়েছি আমার কবিতা সাজাবার জন্য না আলো - না অন্ধকারে তাই কি নির্জনতা গাঢ় হয়। কালো মেঘের বিষণ্ণতার আড়ালে, হয়ত অনেক বৃষ্টিপাতের পর তবেই তু মি হবে উজ্জ্বল উচ্ছ্বল স্নিগ্ধ, আমি আঁচল পেতে নেব তোমার গলে গলে পড়া রং। জাগো চঞ্চল পলাশ গোপনে শুনেছি তোমার ভাষাহীন কত কথা বেধেছি আমার কবিতাকে তোমার ছন্দে চলে যাওয়া দিনের আবছা অন্ধকারে তাই কি উদাসীনতায় ছেয়ে এগিয়ে আসে তোমার বিদায়ক্ষণ! জ্যোৎস্নার উজ্জ্বলতার আড়ালে, হয়ত আবার আসবে তু মি নতু নভাবে নতু নরূপে স্মৃতির আঙিনা জুড়ে, আমি কু ড়িয়ে নেব তোমার ঝরে ঝরে পড়া কথা আমার আরও রং চাই আরও অনেক কথা তারপর --তারপর তোমার চঞ্চলতা ছুঁ য়ে ভাষাময় রঙিন হয়ে উঠুক আমার কবিতা।।